মহামারিকালে ভারতীয় নারীদের ডিম্বাণু সংরক্ষণ কেন বাড়ছে?
নয়াদিল্লির বাসিন্দা ৩৭ বছরের নারী ব্যাংকার সুরভি কুমার। বিয়ে করা বা গর্ভধারণ নিয়ে কখনই আগ্রহ ছিল না তাঁর। তবে সম্প্রতি কোভিড-১৯ মহামারিতে ঘনিষ্ঠ দুই আত্মীয়ের মৃত্যু তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কাছের মানুষ ছাড়া নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বেন এমন উদ্বেগেও ভুগছেন।
সবকিছু ভেবেই সুরভি তাঁর ডিম্বাণু সংরক্ষণ করে রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
এব্যাপারে তাঁর বক্তব্য, "শহরবাসী চাকরিজীবী ও একাকী নারী হিসেবে মানসিকভাবে নিজের একা হয়ে পড়া নিয়ে ভয় পাই। তাই ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে একদিন যাতে গর্ভধারণ করতে পারি- সেজন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সন্তানধারণ কবে করব তা এখনও নিশ্চিত নই, তবে যখন সে সিদ্ধান্ত নেব, তখন যেন উপায় থাকে; সেটি নিশ্চিত করে রাখলাম।"
সুরভির মতো শহরবাসী অনেক অবিবাহিত বা সঙ্গিহীন চাকরিজীবী ভারতীয় নারী তাদের ডিম্বাণু পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করছেন। তাদের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধিও পাচ্ছে। বেশিরভাগেরই বয়স ৩২-৩৮ বছরের মধ্যে।
বৈজ্ঞানিকভাবে এ প্রক্রিয়ার নাম- সোশ্যাল এগ ফ্রিজিং বা ম্যাচিউর ওয়োসাইট ক্রায়োপ্রিজার্ভেশন।
হিমায়িত পদ্ধতিতে ডিম্বাণু সংরক্ষণের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। যেমন কেউ কেউ সঠিক জীবনসঙ্গী খুঁজে না পাওয়ায় গর্ভধারণ করেননি। আবার সুরভির মতো কেউ কেউ পরিবার তৈরির ব্যাপারে আগে কখনো ভাবেননি ।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ডেটিংয়ের সুযোগ কমে যাওয়াটাও আরেকটি বড় কারণ। মহামারি জনিত বিধিনিষেধের কারণে অনেকের বিয়ে পিছিয়েছে। একাকী নারীরাও পছন্দের সঙ্গী বেঁছে নিয়ে গর্ভধারণের সুযোগ হারিয়েছেন।
অবশ্য শুধু ভারতে নয়, ডিম্বাণু সংরক্ষণ করা নারীর সংখ্যা মহামারিকালে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়াতেও একই কারণে বাড়তে দেখা যাচ্ছে। এসবের বাইরে পরিবার থেকে আসা চাপ ভারতে এই বৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা রাখছে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে এখনও অবিবাহিত মায়েদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সামাজিক এ দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে অন্যতম প্রভাবক।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে দিল্লি-ভিত্তিক ফার্টিলিটি স্পেশালিষ্ট অনুপ গুপ্ত বলেন, "পেশাগত জীবনে নারীরা সফল হলেও, বেশিরভাগ ভারতীয় পরিবারই চায়, তাদের কন্যারা বিয়ে করুক ও সন্তান নিক।"
"আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের ফলে এখন অনেক পরিবার মেয়েদের দেরি করে বিয়ে করা মেনে নিচ্ছে। ডিম্বাণু সংরক্ষণ করলে পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত হন যে ভবিষ্যতে তাদের মেয়ে অবশ্যই জীবনসঙ্গী খুঁজবে। তাছাড়া, একবার ডিম্বাণু সংরক্ষণ করলে নারীদের গর্ভধারণের বয়সসীমা নিয়ে খুব একটা ভাবতে হয় না। এমনকি ঋতুস্রাব স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও তারা চাইলে গর্ভধারণ করতে পারেন," যোগ করেন অনুপ।
গুপ্ত জানান, মহামারির কারণে উর্বরতা নিয়ে সঙ্গীহীন নারীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসছে।
"মহামারির আগে আমরা মাসে হয়তো বড়জোর দুই জনের ডিম্বাণু ফ্রিজিং করতাম, আর এখন মাসে অন্তত ছয় জন আসছেন।"
তিনি আরও জানান যে, একবার সংরক্ষণ করার পর বহু বছর পর্যন্ত ডিম্বাণু সক্রিয় থাকে, এবং পরবর্তীতে যেকোন সময় এগুলো দাতার শরীরে পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে তাকে গর্ভধারণের জন্য উপযোগী করে তোলা যায়।
ভারতের অন্যতম বড় উর্বরতা বিষয়ক চিকিৎসা সেবাদাতা ব্লুম আইভিএফ গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির মেডিকেল ডিরেক্টর হৃষিকেশ পাই বলেছেন, "মহামারির আগের সময়ের তুলনায় ডিম্বাণু সংরক্ষণকারী নারীদের সংখ্যা ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
আগামীতে, আইভিএফ- এর ক্লিনিকে আসা নারীদের দেহে উর্বর ডিএনএ শনাক্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহারের কথাও বলেছেন তিনি। গর্ভের চিত্র বিশ্লেষণ করে এআই প্রোগ্রামটি সেখানে থাকা কতগুলি ডিম্বাণু ভ্রূণ পর্যায়ে নিষিক্তের উপযোগী তা চিহ্নিত করবে।
"আমাদের নারী রোগীদের বার বার শারীরিক অসুবিধায় ফেলতে চাই না। একারণে কতগুলি ডিম্বাণু ব্যবহারের উপযোগী তা এআই শনাক্ত করে জানালে সে সমস্যাও দূর হবে। গড়পড়তা ১০-১২টি সংরক্ষিত ডিম্বাণু একজন নারীকে ১০-১৫ বছর পর পর্যন্ত গর্ভধারণের সুযোগ করে দেয়।"
খরচ ও প্রক্রিয়া:
ডিম্বাণু সংগ্রহের আগে একাধিক বার আলট্রাসনো টেস্ট করতে হয়। প্রয়োজন হয় রক্ত পরীক্ষা ও ডিম্বাশয়ে স্টিমুলেশনের। সবকিছু মিলিয়ে ভারতে খরচ করতে হয় প্রায় দুই থেকে তিন লাখ রুপি। শুধুমাত্র বেসরকারি খাতে এ সেবা পাওয়া যায়।
নারীদের ডিম্বাণু নিয়ে এখনও কোনো ভারতীয় আইন তৈরি হয়নি; তবে ফার্টিলিটি ক্লিনিকগুলো সংরক্ষণের আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির লিখিত অনুমতি নেয়। তিনি কতদিন সংরক্ষণ করতে চান- সেটিও উল্লেখ করতে হয় অনুমতিপত্রে। আর যদি নির্দিষ্ট সময় পর ওই ব্যক্তি তার ডিম্বাণু গ্রহণ না করেন; তাহলে সেগুলোর মজুদ বিনষ্টের অধিকার সংরক্ষণ করে ক্লিনিকের কর্তৃপক্ষ।
দাতা নারীকে দশ দিন পর পর হরমোন ইঞ্জেকশন দেওয়ার মাধ্যমে ডিম্বাশয় স্টিমুলেট করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এটি চলাকালে পাঁচ দফায় রক্ত পরীক্ষা এবং ফলিকল বা কোষথলির বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণে আল্ট্রাসাউন্ড টেস্ট করা হয়।
এই কোষথলি থাকে ডিম্বাশয়ের মধ্যে। যেখানে ডিম্বাণুগুলো পূর্ণতা লাভের আগে কয়েকটি স্তর অতিক্রম করে। আল্ট্রাসাউন্ড টেস্ট প্রতিটি সাইকেলে ডিম্বাণুর বৃদ্ধি মনিটর করে।
মুম্বাই ভিত্তিক উর্বরতা বিশেষজ্ঞ অঞ্জলী মালপানি বলেন, "মধ্য তিরিশের একজন নারীর ডিম্বাশয়ে অন্তত ১২টি কোষথলি থাকা উচিত। ডিম্বাণুর সংখ্যা বেশি থাকলে উর্বরতা বাড়ে, যার ফলে ভবিষ্যতে ভ্রূণে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়।"
এভাবে যখন একাধিক ডিম্বাণু পরিণত অবস্থায় পৌছায় তখন ২০ মিনিটের এক সংক্ষিপ্ত পদ্ধতির সাহায্যে সেগুলো অপসারিত করে এম্ব্রায়োলজি ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সংগৃহীত ডিম্বাণুগুলোকে পরীক্ষার পর যেগুলো পরিণত প্রমাণিত হয়, সেগুলোকে অত্যন্ত সতর্কতার সাহায্যে জমিয়ে ফেলা হয়।
এরপর দাতা নারী যখন মা হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন, তখন তার ডিম্বাণুগুলোকে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ফিরিয়ে এনে, সেগুলোর মধ্যে শুক্রাণু প্রবেশ করানো হয়। এরপর সেখান থেকে সৃষ্টি হওয়া ভ্রূণকে জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়।
ডিম্বাণুর মান:
ফার্টিলিটি স্পেশালিষ্ট অনুপ গুপ্ত জানান, মধ্য বিশ বয়সী নারীরাই সবচেয়ে বেশি উর্বরতার অধিকারী, তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবেই ডিম্বাণুর সংখ্যা ও মান হ্রাস পায়।
"দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো; ভারতে বেশিরভাগ ৩২-৩৮ বছর বয়সী নারীরা যখন আর উপযুক্ত জীবনসঙ্গী খুঁজে পান না- তখনই তারা ডিম্বাণু সংরক্ষণের জন্য আসেন," বলছিলেন গুপ্ত।
গেল মার্চে ডিম্বাণু সংরক্ষণ করান মুবাই ভিত্তিক একটি আর্থিক সেবাদাতা কোম্পানির সত্ত্বাধিকারী ৩৫ বছরের জুহি সিং। তিনি অঞ্জলী মালপানির ক্লিনিকে আরও দুই বান্ধবীসহ এসেছিলেন। সৌভাগ্যের বিষয় হলো, জুহি তাঁর প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ১৫টি ডিম্বাণু সংরক্ষণ করতে পেরেছেন।
"আজকে এ সিদ্ধান্ত না নিলে, পাঁচ বছর পরে হয়তো পরিতাপ করতাম। সেটা করতে চাই না বলেই ডিম্বাণু জমিয়ে রেখেছি। তবে এটাও বুঝতে পারছি, আরও কম বয়সে এই সিদ্ধান্ত নিলেই হয়তো ভালো করতাম। তাতে মাতৃত্বের সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যেতো।
অঞ্জলী মালপানি জানান, কয়েক বছর আগে ডিম্বাণু সংরক্ষণ করা অনেক গ্রাহক ইতোমধ্যেই শুক্রাণু দাতাদের সাহায্যে গর্ভধারণ করেছেন।
"সব ভারতীয় নারীই উপযুক্ত সঙ্গীর পথ চেয়ে চিরকাল বসে থাকার পাত্রী নন। তারা নিজেদের মাতৃত্বের সিদ্ধান্ত, নিজেরাই নেওয়া শিখছেন," যোগ করেন অঞ্জলী।
- সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট