বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিন নিয়ে হাহাকারের মধ্যে ধনী দেশগুলোর 'বুস্টার ডোজ' দেওয়া উচিত নয়
২০২০ সালের শুরুতে কোভিড-১৯ মহামারির করুণ বাস্তবতা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে; লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, স্বাভাবিক সামাজিক যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে, অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, সেই সঙ্গে বিশ্বকেও পড়তে হয়েছে এক অনিশ্চয়তার মাঝে। প্রায় সাড়ে তিন থেকে সাড়ে এগারো মিলিয়নের বেশি মানুষ মারা গিয়েছে ইতোমধ্যেই। তবে এই চরম শঙ্কার মাঝে টিকা কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছে।
টিকা উন্নয়ন নিঃসন্দেহে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য এক বড় জয়; এমন সংকটাপন্ন মুহূর্তে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডোজ টিকা উৎপাদন সত্যিই আনন্দদায়ক। শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যেই ৮৪ মিলিয়ন ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে, যা কমপক্ষে ৮৪ হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। এছাড়া আশা করা হচ্ছে, টিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।
তাহলে বিশ্বজুড়ে এখনও কেনো এত দুর্ভোগ? প্রতি সপ্তাহে হাজার হাজার মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। অনেক দেশেই হাসপাতালগুলোয় রোগী ভর্তি নেওয়ার জায়গা হচ্ছে না; এবং তারা জরুরিভাবে আবেদন জানাচ্ছে, যেনো তাদেরকে টিকা সরবরাহ করা হয়। কারণ, তাদের কাছে জীবন রক্ষাকারী এই টিকা পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। আর আমরা এই পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েছি কারণ, প্রথমেই টিকা যাদের সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিলো এবং যাদের আক্রান্ত হওয়ারও সম্ভবনা বেশি ছিলো, তাদের মাঝে টিকার সুষ্ঠু বণ্টন আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। এই বছর কোভিডের কারণে যারা মারা যাবে তাদের অধিকাংশই রক্ষা পেতে পারত, যদি আমরা টিকার বণ্টন সঠিকভাবে করতাম।
অধিক ঝুঁকিপূর্ণদের মাঝে টিকার সুষ্ঠু বণ্টন আমাদেরই স্বার্থ রক্ষা করে। এর মাধ্যমে নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর থেকে মাত্রাতিরিক্ত চাপ কমবে। ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে, বৈশ্বিক অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হবে এবং নৈতিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রস্তুত এমন রাজনীতিবিদদের আন্তর্জাতিক কর্তৃত্বও বৃদ্ধি পাবে।
দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, এই বছরের শেষ নাগাদ আরও প্রায় এক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হবে কোভিড মহামারিতে এবং হাজারও মানুষ টিকা না পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। অথচ এই পরিস্থিতিতেও পাশ্চাত্য নেতারা নাগরিকদের জন্য দুই দোজ টিকা নিশ্চিত করার পরে, আরও এক ডোজ টিকা দেওয়ার কথা ভাবছেন।
বৈশ্বিক টিকা সংকটের এমন চরম মুহূর্তে আমাদের বুস্টার ডোজ নেয়ার প্রয়োজন আছে কিনা এ ব্যাপারে একটি শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এবং আমাদেরকে অবশ্যই সময় ও গুরুত্ব বিবেচনায় সচেতন হতে হবে; যদি কারও বুস্টার ডোজ প্রয়োজন হয়, তাহলে সেটা অবশ্যই এমন কাউকে বঞ্চিত করে নয় যার জীবন বাঁচানোর জন্য টিকা সবচেয়ে বেশি জরুরি। অর্থাৎ, কারও জীবনকে তুচ্ছ করে, অন্য কারও জন্য অধিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা কখনই কাম্য হতে পারে না।
বুস্টার ডোজ বিষয়ক বৈজ্ঞানিক ও জনস্বাস্থ্যের গবেষণাগুলো এখনো অসম্পূর্ণ এবং অস্পষ্ট। আমরা জানি, টিকা গ্রহণের পর সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে; ফলে বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হয়। যদি সত্যিই উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবডি ছোটখাটো সংক্রমণ রোধে আরও ভালোভাবে কাজ করে, তাহলে সম্ভবত বুস্টার ডোজের প্রয়োজন আছে। কিন্তু টিকা নীতি অবশ্যই স্বল্পমাত্রার সংক্রমণ প্রতিরোধে উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবডি বজায় রাখার উপর ভিত্তি করে হতে পারে না; বরং আমরা যদি একাই অ্যান্টিবডি লেভেলকে ভিত্তি হিসেবে নির্ধারণ করি, তাহলে ক্রমাগত পরিবর্তনশীল এই ভাইরাস মোকাবেলায় আমরা সবাইকে সমানভাবে একাধিকবার টিকা দিতে সক্ষম হবো।
টিকা দেয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো, হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যু রোধ করা; মানুষকে স্বল্পমাত্রার সংক্রমণ থেকে বাঁচানো নয়।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, টিকার কোর্স সম্পন্ন করা ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই এখন কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছে। টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তিকে চক্রাকারে আক্রান্ত করা মূলত করোনা ভাইরাসের একটি সাধারণ ধরণ। এতে উদ্বেগের তেমন কোনো আবশ্যকতা নেই। কারণ টিকা এখনও গুরুতর রোগের বিরুদ্ধে উচ্চ মাত্রায় সুরক্ষা প্রদান করে যাচ্ছে। টিকা আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে; এমনকি অ্যান্টিবডির স্তর নিচে নেমে গেলেও এটা এভাবেই কাজ করবে।
সুতরাং মানুষ সংক্রমিত হবে কি না তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার পরিবর্তে, সেই সংক্রমণ গুরুতর রোগ সৃষ্টি করে কিনা, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কিংবা অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে কিনা, তা নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।
যেই তথ্যটি আমাদের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো, অ্যান্টিবডি বা টি-সেলের কোন স্তর মানুষকে গুরুতর অসুস্থ হওয়া থেকে সুরক্ষা দেবে। কিন্তু এই তথ্যটি বৈজ্ঞনিক গবেষণায় এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। অ্যান্টিবডির সেই স্তরকে যদি আমরা সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারি বা নিশ্চিত হতে পারি, তাহলে বুস্টার ডোজ প্রয়োজন আছে কিনা সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা এখনও টিকার প্রথম ডোজের জন্য অপেক্ষায় আছে।
তাই এখন আমরা যা করতে পারি তা হলো, ক্লিনিকাল ডেটা বিশ্লেষণ করে বের করতে হবে কখন বা ঠিক কোন মুহূর্তে গিয়ে বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হয়। আর এই পর্যবেক্ষণটির দায়িত্বে আছে জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আশা করা যায়, দ্রুতই পর্যবেক্ষণের ফল পাওয়া যাবে এবং সেই মোতাবেক নীতি গ্রহণ করা হবে।
কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে আমরা অনিশ্চিত। হয়তো আমাদের বুস্টার ডোজ দেয়া উচিত, হয়তো নয়। দুই পক্ষেই যথেষ্ট যুক্তি আছে। পীত জ্বরের মাত্র এক ডোজ টিকাই জীবনভর সুরক্ষা নিশ্চিত করে, যেখানে টিটেনাসের জন্য আমাদের পাঁচ বা ছয় ডোজ টিকা নিতে হয় এবং ফ্লুয়ের জন্য টিকা দিতে হয় প্রতি বছর। তাহলে কোভিড টিকার বেলায় কোনটি যুক্তিযুক্ত?
এটি মোটামুটি অসম্ভব যে, গুরুতর রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন হঠাৎই অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং মহামারি খুব বিপর্যয় আকার ধারণ করে পুনরায় তান্ডব চালাতে থাকবে। বরং এই ভাইরাসটি আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হয়ে টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তির শরীরে ভালোভাবেই বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু সেই পরিবর্তন বা মিউটেশন আমাদের টিকার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করতে পারবে না। টিকার মাধ্যমে আমরা করোনা ভাইরাসের মারাত্মক রোগ সৃষ্টিকারী ভ্যারিয়েন্টগুলো থেকে অবশ্যই সুরক্ষিত থাকবো।
তাই এটি কোনো বির্তকের বিষয় নয়। যারা টিকার কোর্স সম্পন্ন করেছে তাদেরকে তৃতীয় ডোজ দেওয়ার আগে সেই জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে হবে যারা এখনও প্রথম ডোজই পায়নি।
নীতি নির্ধারকদের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। ধনী দেশগুলো কর্তৃক বড় আকারে বুস্টার ডোজ দেওয়া পুরো বিশ্বকে এই বার্তা দিবে যে, বুস্টার ডোজের আবশ্যকতা আছে। এই প্রক্রিয়ায় অনেক ডোজ টিকা স্বল্প প্রয়োজনে ব্যাবহার করা হবে, যেখানে অনেকেই মাত্র এক ডোজ টিকার জন্য জীবন হারাতে বসবে। একটি শক্তিশালী বাস্তব বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া যদি মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়, তাহলে ইতিহাস সাক্ষী হয়ে থাকবে আমাদের জীবনদশায় বৈশ্বিক এই সংকটের মুহূর্তে বিশ্ব নেতারা কীভাবে মানবতার প্রতি তাদের দায়িত্বকে প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নেন।
যেহেতু আমাদের দুই ডোজ টিকা নিশ্চিত করার সক্ষমতা রয়েছে, তাই আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষকে বুস্টার ডোজ দিতে উৎসাহিত করা উচিত হবে না; যেখনে অনেকের হাতে কিছুই নেই এবং তাদের সময়ও শেষ হয়ে যাচ্ছে। সহজ কথায়, প্রথম ডোজ আগে নিশ্চিত করতে হবে সবার জন্য।
- লেখক:
- অ্যান্ড্রু পোলার্ড: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপের পরিচালক
- সেথ বার্কলে: বৈশ্বিক ভ্যাকসিন জোট গ্যাভির প্রধান নির্বাহী।
সূত্র- দ্য গার্ডিয়ান