আমেরিকাতেও ফেলা হয়েছিল দুটো পারমাণবিক বোমা, ধ্বংস হয়ে যেতে পারত গোটা অঙ্গরাজ্য
১৯৬১ সালের ২৩ জানুয়ারি আমেরিকার উত্তর ক্যারোলাইনার গোল্ডসবোরোতে দু'টি পরমাণু বোমা পড়েছিল। আমেরিকার কোনও বিরোধী দেশ কিন্তু সেগুলো ফেলেনি। আমেরিকারই একটি সেনা বিমান থেকে এই দু'টি বোমা পড়েছিল। একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছিল উত্তর ক্যারোলাইনা। তা না হলে আরও এক হিরোশিমা দেখতে হতো পৃথিবীকে!
গোল্ডসবোরোর সেমর জনসন বিমানঘাঁটি থেকে মাঝরাতে বি-৫২জি বোমারু বিমানে ওই দু'টি বোমা নিয়ে উড্ডয়ন করেন। মাঝ আকাশে পরীক্ষামূলক জ্বালানি ভরছিল বিমানটি।
তেল নেওয়ার সময়ই বি-৫২জি তে বড়সড় সমস্যা দেখতে পান জ্বালানি ভরার বিমানের পাইলট। বোমারু বিমানটি থেকে তেল লিক করছিল। সঙ্গে সঙ্গেই সতর্ক করা হয় পাইলটকে। বি-৫২ এর এয়ারক্র্যাফ্ট কম্যান্ডার ছিলেন মেজর ওয়াল্টার স্কট।
ওই সতর্কবার্তার পরমুহূর্তেই জ্বালানি ভরা বন্ধ করে নিরাপদ দূরত্বে বিমানটিকে উড়িয়ে নিয়ে যান বি-৫২ এর পাইলট। তিনি ভেবেছিলেন অতিরিক্ত জ্বালানি বেরিয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে নিরাপদে বিমানটিকে অবতরণ করাবেন। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি।
যে গতিবেগে জ্বালানি বেরোতে শুরু করেছিল তা কল্পনাও করতে পারেননি পাইলট। মাত্র তিন মিনিটে ১৭ হাজার কেজি জ্বালানি বেরিয়ে গিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ বিমান ঘুরিয়ে গোল্ডসবোরোর সেমর জনসন বিমানঘাঁটির দিকে রওনা দেন। কিন্তু পৌঁছতে পারেননি।
মাটি থেকে ১০ হাজার ফুট উচ্চতায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। পাক খেতে খেতে নীচে নেমে আসতে শুরু করে বিমান। অবস্থা বেগতিক বুঝে নয় হাজার ফুট উচ্চতায় পৌঁছলে চালক বিমান খালি করার নির্দেশ দেন। পাঁচজন নিরাপদে প্যারাশুটে নীচে নেমে আসতে পেরেছিলেন। ঠিকমতো অবতরণ করতে না পারায় একজনের মৃত্যু হয়েছিল। বাকি দুই জন দু'হাজার ফুট উচ্চতায় বিমান বিস্ফোরণে মারা যান।
এই দুর্ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল আমেরিকাকে। ওই বিমানে থাকা দু'টি পরমাণু বোমা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল গোটা বিশ্ব। হিরোশিমায় ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল যে পরমাণু বোমা, তার চেয়ে ২৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল এই দু'টি বোমা। এতটাই শক্তিশালী ছিল যে অন্তত ১৪ কিলোমিটার ব্যাস জুড়ে এলাকা নিমেষে মরুভূমিতে পরিণত করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত।
অনুসন্ধানের পর বোমা দু'টি উদ্ধার হয় ঠিকই কিন্তু যে অবস্থায় উদ্ধার হয়েছিল তা ঘুম উড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। তার মধ্যে একটি বোমা প্যারাশুটে লেগে থাকা অবস্থায় গাছে ঝুলছিল। সেই বোমা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার তেমন কোনও কারণ ছিল না। কারণ সে ক্ষেত্রে বোমাটি তখনও সক্রিয় হয়নি।
কিন্তু অন্য বোমার ধ্বংসলীলা থেকে একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছিল উত্তর ক্যারোলাইনা। বিস্ফোরণের আগে যতটা সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন, তার প্রায় অর্ধেক সক্রিয় হয়ে উঠেছিল সেটি।
ঘণ্টায় প্রায় হাজার কিমি গতিবেগে নীচে নেমে এসেছিল ওই পরমাণু বোমাটি। গোল্ডসবোরোর ভেজা মাটিতে প্রায় ২০ ফুট গভীরে পুঁতে গিয়েছিল। বোমাটির অর্ধেকেরও বেশি সক্রিয় হয়ে গিয়েছিল তখন। খুব সাবধানে বোমার ভিতর থেকে বিস্ফোরক বের করে নিয়ে এনেছিলেন বোমা বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু ভিতরের বেশিরভাগ ইউরেনিয়াম এবং প্লুটোনিয়াম যত্রতত্র ছড়িয়ে যাওয়ায় সেগুলোর সবটা বের করে আনা সম্ভব হয়নি। তার উপর জায়গাটি পানিতে পরিপূর্ণ থাকায় কাজ করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল।
নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে বোমার চারপাশে ৪০০ বর্গফুট এলাকা ঘিরে ফেলেছিল আমেরিকার সৈন্যরা। জল কমলে মাটি খুঁড়ে বোমার পুঁতে থাকা সেই অংশ উদ্ধার করেছিল আমেরিকার সেনা ইঞ্জিনিয়াররা। দীর্ঘদিন এই এলাকা ঘিরে রেখেছিল সেনারা। সাধারণ মানুষ সেখানে প্রবেশ করতে পারত না।
আমেরিকার স্যান্ডিয়া ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজের সুপারভাইজার পার্কার এফ জোনস পরবর্তীকালে ওই এলাকা পরিদর্শন করে রিপোর্ট দিয়েছিলেন, "আমেরিকা এবং বড় বিপর্যয়ের মাঝে দাঁড়িয়েছিল একটি লো-ভোল্টেজ সুইচ।" তার পর্যবেক্ষণ ছিল, বিমান দুর্ঘটনার সময় যদি কোনভাবে বোমাটির আর্ম লাইনে শর্ট সার্কিট হয়ে যেত তা হলে বিপর্যয় কাটানো যেত না।
পরবর্তীতে সে এলাকায় চাষাবাদের অনুমতি মেলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। কিন্তু এখনও সেখানে ঘরবাড়ি তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়নি। ২০১২ সালে উত্তর ক্যারোলাইনার প্রশাসন এই এলাকাকে ঐতিহাসিক স্থান হিসাবে চিহ্নিত করে। এই এলাকা থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে 'নিউক্লিয়ার মিশাপ' নামে একটি বোর্ড লাগিয়ে দেয়।
- সূত্র- আনন্দবাজার পত্রিকা