দেশের মসজিদে প্রথম জঙ্গি হামলার বিচার হয়নি আজও
বগুড়ায় শিয়া মসজিদে জঙ্গি হামলার চার বছর পার হলেও বিচার কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর গ্রামের মসজিদ-ই-আল মোস্তফায় হামলা হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন মসজিদের মোয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেনসহ চারজন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান মোয়াজ্জেম।
বগুড়া পুলিশের তথ্যমতে, দেশের কোনো মসজিদে জঙ্গি হামলার ঘটনা এটাই ছিল প্রথম। পরে ওই মসজিদ কমিটির কোষাধ্যক্ষ সোনা মিয়া বাদি হয়ে ঘটনার দিন রাতেই শিবগঞ্জ থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন।
পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল মতিন বলেন, মামলার প্রধান অভিযুক্ত ও হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ইয়াছিনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় অনেক মামলা থাকায় তাকে কাশিমপুর কারাগার থেকে বগুড়া আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না। আদালত আসামির বক্তব্য শুনে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করতে চায়। কিন্তু আসামিকে বগুড়ায় হাজির করা সম্ভব না হওয়ায় অভিযোগই গঠন করা যায়নি, ফলে বিচারকাজও শুরু হয়নি।
তিনি আরও জানান, এ মামলায় আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াছিন আলীকে বগুড়া জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির করতে পরবর্তী দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে তাকে আদালতে হাজির করার দিন ছিল ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর।
বগুড়া জেলা কারাগারের সুপার সাইদ হোসাইন বলেন, আলোচিত এ মামলার মূল আসামি ইয়াছিন আলীকে বিচারকের নির্দেশনা অনুযায়ী বগুড়ায় আনার ব্যবস্থা করা হবে।
আদালত সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি বগুড়া আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শিবগঞ্জ থানার তৎকালীন পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান। পরে আমলি আদালতের বিচারক অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলায় অংশ নিয়েছিল জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও ইসলামি ছাত্রশিবিরের প্রশিক্ষিত ১৩ সদস্য। এর মধ্যে চারজন কারাগারে আছেন। পাঁচজন পলাতক ও চারজন পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। অভিযুক্তরা প্রত্মতাত্ত্বিক সাইট মহাস্থানগড়ে বসে হামলা ও মোয়াজ্জিনকে হত্যার জন্য বৈঠক করে। পরে স্কুলব্যাগে অস্ত্র ও গ্রেনেড নিয়ে দুটি মোটরসাইকেলে ছয়জন ওই মসজিদে হামলা করে। নামাজরত মুসল্লিদের ওপর হামলার পর মোটরসাইকেলে চড়েই পালিয়ে যায় হামলাকারীরা। এর আগে জেএমবি নেতারা শিয়া সম্প্রদায়কে ‘কাফের’ ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের সিদ্ধান্ত নেয় এবং তারই অংশ হিসেবে এ হামলা করা হয়।
মামলায় যে ৯ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগপত্র দাখিল করেছে তারা হলেন- জয়পুরহাট সদরের সোঠাহার গ্রামের ইয়াছিন আলী (৪০), বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার আটমুল গ্রামের ফকিরপাড়ার এমদাদুল হক (২৮), কুলুপাড়া গ্রামের আবদুল বাছেদ (২৭), পূর্বকুলুপাড়া গ্রামের আবদুল হামিদ ওরফে হামিদুল (২২), বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার কামারপাড়া গ্রামের আবদুল মমিন মণ্ডল (২৫), একই উপজেলার ক্ষুদ্র কুষ্টিয়া গ্রামের রাজিবুল ইসলাম ওরফে বাদল (২৬), গাবতলী উপজেলার গোরদহ সরকারপাড়া গ্রামের খাদেমুল ইসলাম ওরফে বাদশা (২৪), আজাদ প্রামাণিক (২৪) এবং গাইবান্ধা সদর উপজেলার তিনদহ পশ্চিমপাড়ার আজাদুল কবিরাজ ওরফে বিপ্লব (৩২)। চারজন পুলিশের সঙ্গে নিহত হওয়ায় তাদের নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়।
অভিযুক্তদের মধ্যে কারাগারে আছেন- ইয়াসিন, এমদাদুল, বাসেদ ও মমিন। পলাতক রয়েছেন- বাদল, হামিদুল, খাদেমুল, আজাদ ও বিপ্লব। ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ইয়াছিনকে ২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর জয়পুরহাট থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। একই দিন শিবগঞ্জ থেকে জেএমবির দুই সদস্য আবদুল বাছেদ ও এমদাদুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন হামলার আদ্যোপান্ত জানিয়ে বগুড়া আদালতে ১৬৪ ধারায় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
জবানবন্দিতে ইয়াছিন বলেন, ‘শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন দিনে তিন ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)- কে ব্যঙ্গ করে। এ কারণেই তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ এবং মসজিদে হামলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।’
ইয়াসিনের দেওয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার মধ্যকামারপাড়া গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের ছাত্র আবদুল মমিনকে (২৫)। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় হামলায় ব্যবহৃত আমেরিকায় তৈরি অত্যাধুনিক পয়েন্ট ২২ বোরের একটি রাইফেল, একটি বিদেশি পিস্তলসহ ৫২টি তাজা গুলি।
জঙ্গি সদস্যরা হরিপুর মসজিদ-ই-আল মোস্তফায় গিয়ে মাগরিবের নামাজে আসা মুসল্লিদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর দুটি মোটরসাইকেলে করে কাওছার, রানা, বিপ্লব, বাদশা, বাদল ও আনোয়ার মহাস্থানগড়ে একত্র হন। সেখান থেকে স্কুলব্যাগে ভরে অস্ত্র ও গ্রেনেড নিয়ে জঙ্গীরা শিয়া মসজিদের হামলার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। মসজিদের পাশে একটি ইটভাটায় মোটরসাইকেল রেখে বাদল ও বিপ্লব অপেক্ষা করতে থাকেন। আর কাওছার, আনোয়ার, রানা ও বাদশা মসজিদে হামলায় অংশ নেয়। তারা মসজিদের বাইরের ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। এরপর রানা মসজিদের মূল দরজা বন্ধ করে দেন। জঙ্গি আনোয়ার একে ২২ অস্ত্র দিয়ে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই হামলা শেষ করে পালিয়ে যায় তারা।