নারীর বিরুদ্ধে মোরাল পুলিশিং ও গণমাধ্যমের অসংবেদনশীলতা পুরুষতান্ত্রিক জনমতকে প্রতিষ্ঠা করে: স্ফুলিঙ্গ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের মনমতো পরামর্শ দেওয়ার আড়ালে অবমাননাকর মন্তব্য ও প্রচারণা 'মোরাল পুলিশিং' নামে পরিচিত। বাংলায় কেউ কেউ একে 'নীতি পুলিশিং'ও বলে। ইন্টারনেট সাধারণত এ ধরনের আচরণের মারাত্মক শিকার হন নারীরা।
এ ধরনের মোরাল পুলিশিং, গণমাধ্যমে নারীকে অসংবেদনশীলভাবে তুলে ধরা এবং আইন ও বিচার বিভাগে পক্ষপাতদুষ্টের অভিযোগ তুলে শনিবার সকাল ১১টায় এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে 'স্ফুলিঙ্গ' নামে একটি প্ল্যাটফর্ম।
রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলরুমে 'নারীর বিরুদ্ধে মোরাল পুলিশিং, গণমাধ্যমের অসংবেদনশীলতা এবং আইন ও বিচার বিভাগে পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে আমরা' শীর্ষক ওই গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময়ে, একইসঙ্গে আত্মপ্রকাশও ঘটে নারীদের সম্মিলিত উদ্যোগে তৈরি হওয়া প্ল্যাটফর্মটি।
'স্ফুলিঙ্গ'র সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, স্বশরীরে ও ভার্চুয়াল মাধ্যমে আলোচক হিসেবে ওই গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সানজিদা নীরা, আইনজীবী সুলতানা আক্তার রুবি, বাংলাদেশ সাম্যবাদী আন্দোলনের সদস্য ও আলোকচিত্রী জান্নাতুল মাওয়া, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সম্পাদক খান আসাদুজ্জামান মাসুম, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য লুনা নুর, নারী মুক্তি কেন্দ্রের ঢাকা নগরের সভাপতি তাসলিমা বিউটি, বিপ্লবী নারী ফোরাম ঢাকা নগরের সদস্য আমেনা আক্তার, আইনজীবী তাসমিয়াহ নুহাইয়া আল আমিন, কথাসাহিত্যিক নুরন্নবী শান্ত, কবি ও সাংবাদিক রহমান মুফিজ, উন্নয়নকর্মী ফেরদৌস আরা রুমী, ওয়াইডাব্লিউসি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জেসমিন দিনাসহ প্রায় চল্লিশজন অ্যাকটিভিস্ট।
বৈঠকের শুরুতেই কর্মসূচির অবস্থানপত্র পাঠ করেন 'স্ফুলিঙ্গ' সদস্য পূরবী তালুকদার। বৈঠকটি যৌথভাবে সঞ্চালনা করে 'স্ফুলিঙ্গ' সদস্য মোশফেকা আরা শিমুল ও ইশরাত জাহান উর্মি।
বৈঠকে আলোচকরা বলেন, 'বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, নারীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোরাল পুলিশিং এবং গণমাধ্যমে নারীর ব্যক্তিগতজীবনকে উন্মুক্ত করে কেলেঙ্কারিকরণের সংবাদ প্রচার করে সমাজের প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক জনমতকে প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং তাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রভাবশালীদের অপরাধকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়। এর পাশাপাশি বিচারবিভাগের বিশেষ ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক আইনের অপব্যবহার করে নারীদের নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করার বিষয়টি প্রায়শই পরিলক্ষিত হচ্ছে।'
'স্ফুলিঙ্গ'র সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দাবি করেন, গণমাধ্যম নারীবিদ্বেষী এইসব সংবাদ পরিবেশন করে মূলত জনমত তৈরি করতে যা ইতোমধ্যে ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালা দিয়ে সমাজে প্রচলিত রয়েছে। এই প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, একজন গার্মেন্টস শ্রমিক নারীকে মজুরি কম দিতে এবং প্রতিবাদ থামানো সহজ হয় যখন তার ব্যক্তিগত চরিত্রকে উন্মুক্ত করে তার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডামূলক তথ্য প্রচার করা হয়।
অনলাইন মাধ্যমে যুক্ত হয়ে অধ্যাপক সানজিদা নীরা বলেন, 'গণমাধ্যম এবং বিজ্ঞাপনসমূহ তাদের কাটতি বাড়াতে নারীদের নিয়ে এই ধরনের অসংবেদনশীল সংবাদ পরিবেশন করে। নারীকে এভাবে উপস্থাপন না করেও যে গণমাধ্যম চলতে পারে এই ধারণায় আসতে হবে।'
আলোকচিত্রী জান্নাতুল মাওয়া তার সাংবাদিক পেশাজীবনের একটি ঘটনা উল্লেখ্য করে জানান, অসংবেদনশীল সংবাদ প্রকাশ দায়িত্ব দেওয়া হলে প্রতিবাদস্বরূপ পদত্যাগ করেছিলেন তিনি। অন্যদিকে লুনা নুর বলেন, 'সংবেদনশীলতা এবং অসংবেদনশীলতার বিষয়ের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, এইসকল বিষয় একজন নারীর অধিকারের বিষয়। সমাজে যেকোনো দৃষ্টিভঙ্গি এবং মনস্তত্ত্বের মানুষ নারীর এই অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে না।'
আইনজীবী সুলতানা আক্তার রুবি ১৯৯৫ সালের ইয়াসমিন ট্র্যাজেডির ঘটনাটি স্মরণ করে বলেন, 'তখন একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল ইয়াসমিনের ন্যায়বিচারের পক্ষে। পুরো দেশের সামাজিক আন্দোলন, জনমানুষের আন্দোলন ইয়াসমিন ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ড অপরাধে ন্যায়বিচারকে সম্ভব করেছিল। অথচ আমাদের এখন সেই গণতান্ত্রিক পরিবেশটাই নেই।'
ওই গোলটেবিল বৈঠকে 'স্ফুলিঙ্গ'র পক্ষ থেকে ৮ দফা দাবি আহ্বান করা হয়। দাবিগুলো হলো:
১. গণমাধ্যমকে মুক্ত এবং স্বাধীন করতে হবে।
২. আইনের অপব্যবহার করে নাগরিকের ব্যক্তিপরিসরে ঢুকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা বন্ধ করতে হবে।
৩. প্রতিটি গণমাধ্যম এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে নারীর বিরুদ্ধে অসংবেদনশীল আচরণ, শব্দ চয়ন এবং ছবি ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
৪. গণমাধ্যমে নারীর বিরুদ্ধে অসংবেদনশীল সংবাদ পরিবেশন, শব্দ চয়ন এবং ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
৫. প্রতিটি সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমকর্মীদের উল্লেখিত নীতিমালা বিষয়ে অবগত করতে হবে এবং জেন্ডার সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
৬. নারীর বিরুদ্ধে সমাজের প্রচলিত মোরাল পুলিশিংয়ের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে সোচ্চার থাকতে হবে।
৭. নারীর সহিংসতা সংক্রান্ত অভিযোগ স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে হবে। এসকল অভিযোগে তদন্ত না করে অভিযুক্তকে আইনি প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে না।
৮. বিচার বিভাগকে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ করতে হবে।