৬৩ এশিয়ান হাতির মুক্ত বিচরণের পথ রুদ্ধ, ক্রমে বাড়ছে হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব
মানবিক কারণে বিশ্বের বৃহৎ শরণার্থী ক্যাম্প আর রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সেনা ক্যাম্প দুটোই করা হয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ ও রামুর বিস্তীর্ণ পাহাড় ঘিরে। উখিয়া-টেকনাফে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসতি গড়তে ধ্বংস হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার একর বন। এতে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে হাতি চলাচলের উখিয়া-ঘুমধুম করিডোর। আর রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে গড়ে উঠা রামু ক্যান্টনমেন্টের বিশাল এলাকার জন্য বন্ধ হয়েছে পানেরছড়া-তুলাবাগান করিডোরটিও। এসব কারণে দক্ষিণ বনবিভাগের দখল হয়ে যাওয়া পাহাড়ে বিচরণ করা ৬৩টি এশিয়ান হাতি সম্পূর্ণ আবদ্ধ হয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. হুমায়ূন কবির। এসব কারণে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে হাতির পাল। ফলে মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব ক্রমে বাড়ছে কক্সবাজারে।
ডিএফও বলেন, "হাতি এমন এক প্রাণী যারা দলবেঁধে নিজস্বতায় করিডোর দিয়ে একস্থান হতে অন্যস্থানে যাওয়া-আসা করে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দুটি করিডোর অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চলাচলে বাঁধা পেয়ে প্রায়শই লোকালয়ে হানা দেয় বন্যহাতির পাল। এতে তারা ক্ষতি করছে ফসলের; ফলে মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে দিন দিন। বাড়ছে হাতি হত্যার ঘটনাও। এটি রদে বনবিভাগ ও প্রশাসন আপ্রাণ চেষ্টা করেও সফল হচ্ছে না। বনভূমি পুনরুদ্ধারে বনবিভাগ ব্যাপকভাবে বনায়নের মাধ্যমে হাতির আবাসস্থলের উন্নয়ন চেষ্টা চলমান রাখলেও এর সুফল পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে"।
দক্ষিণ বনবিভাগ সূত্রের দেয়া তথ্যমতে, গেল চার বছরে ৯টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে তিনটি হাতি বৈদ্যুতিক ফাঁদ দিয়ে হত্যার প্রমাণ মিলেছে। গত ৩১ আগস্ট নিহত হাতিটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। একই সঙ্গে উখিয়া-টেকনাফ-রামুর বনাঞ্চলে এখন ৬৩টি হাতি রয়েছে, যেখানে শিশু হাতির সংখ্যা ১০-১২টি। রামুর রাজারকুল, খুনিয়াপালং, পানেরছড়া, গাইন পাড়া, টেকনাফের হ্নীলা, শীলখালী, নাইটং পাড়া, উখিয়ার ঘুমধুম, পালংখালী হাতির চলাচল ও লোকালয়ে আসার পথ হিসেবে চিহ্নিত।
কক্সবাজারে বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীলদের মতে, রোহিঙ্গা আসার পরে আবাসস্থল হারিয়েছে দক্ষিণ বন-বিভাগের আওতাধীন এলাকায় থাকা হাতিগুলো। আবাসস্থলের পাশাপাশি চরম খাদ্য সংকটের কারণে লোকালয়ে চলে আসছে হাতি। কিন্তু তাদের শান্তভাবে ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেই। এখন প্রয়োজন হাতি রক্ষার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের ধোয়াপালং রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, "বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকার পাদদেশ ও আশপাশে জোত (খতিয়ানভুক্ত) জমি রয়েছে। এখানে চাষ করা ফসলে হাতির পাল হানা দেয়। ফসলে হাতির হানা রোধে অনেকে আইন বহির্ভূতভাবে বৈদ্যুতিক ফাঁদ পাতে। গত বছরের শেষ দিকেও একটি হাতি মারা যাবার পর বৈদ্যুতিক ফাঁদ না পেতে চাষাবাদ করতে গত জানুয়ারিতে সচেতনতামূলক সভা করা হয়। সভার পর করা হয় মাইকিংও। সেসময় বলা হয়, হাতির পাল ফসল নষ্ট করলে আবেদনের ভিত্তিতে বনবিভাগ যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিবে। বন্যপ্রাণীর চলাচল রদে এভাবে বৈদ্যুতিক ফাঁদ পাতা বেআইনি। এর কঠিন শাস্তি রয়েছে। এরপরও বন্যপ্রাণী হত্যার গোপন তৎপরতা করছে দুর্বৃত্তরা"।
রেঞ্জার সাজ্জাদ আরো বলেন, "হাতি হত্যা বন্ধে চিহ্নিত এলাকায় ২৫ হাজার লিফলেট বিতরণসহ নানা তৎপরতা চালানো হয়। তারপরও কিছু অসাধু লোক হাতির প্রতি নৃশংসতা বন্ধ করেনি। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে"।
রেঞ্জ কর্মকর্তা সাজ্জাদ আরো বলেন, "গত ৩১ আগস্ট বৈদ্যুতিক ফাঁদে মাদি হাতিটিকে হত্যার পর নৃশংসভাবে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয়েছে। এ ঘটনায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে আমি বাদী হয়ে একটি মামলা আদালতে এবং অপর মামলাটি থানায় রুজু করেছি। জমির মালিক নজির আহমদকে ধরার পর হাতি হত্যার সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে। তার স্বীকারোক্তি মতে, ঘটনায় জড়িত ১২ জনকে এসব মামলায় আসামী করা হয়েছে"।
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, মা হাতিটি হত্যা পরবর্তী পরপর দুই রাতে বন্য হাতির বড় একটি পাল ঘটনাস্থলের আশেপাশে ঘোরাফেরা এবং চিৎকার করেছে। এতে স্থানীয় লোকজন যেকোন সময় বন্য হাতি দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। পরে বনকর্মী, ইআরটি সদস্য, ফরেস্ট ভিলেজাররা নানা কৌশলে সংক্ষুদ্ধ বন্য হাতির পাল গভীর বনে ফেরাতে সক্ষম হয়। মূলত রোহিঙ্গা বসতি ও বিশাল পাহাড় দখলের কারণে আবাসস্থল হারানোর পাশাপাশি তৈরি হয়েছে চরম খাদ্য সংকট। যার ফলে প্রতিনিয়ত লোকালয়ের দিকে চলে আসছে হাতিগুলো।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের সদর রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা সমীর রঞ্জন সাহা বলেন, "হাতি বা বন্যপ্রাণী হত্যার পর নিজেদের বাঁচাতে নানা তৎপরতা চালায় দুর্বৃত্তরা। মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) খুনিয়াপালংয়ে হাতি হত্যার ঘটনায় আটক নজির আহমেদের পায়ে একটি প্লাস্টার ছিল। পারিবারিক বিরোধের জেরে সংঘর্ষে তার পা কেটে যাওয়ায় প্লাস্টার করা হয়েছে বলে দাবি করে সে। হাতি হত্যায় তার স্বীকারোক্তিতে তাকে কারাগারে পাঠাতে আদালতে নেয়ার পর বিপত্তি আসে। পায়ে আঘাত দেখে তাকে কারাগারে পাঠাতে রাজি নয় কোর্ট পুলিশ। পরে বনকর্মীরা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে প্লাস্টার খুলে দেখে পায়ে কোন ক্ষত নেই। এতে চিকিৎসক ও বনকর্মীরা রীতিমত হতবাক"।
এর মূল কারণ ব্যাখা করতে গিয়ে আসামী নজির আহমেদ বলেন, আইনী সহযোগিতা সহজ করতে পায়ে অভিনব পন্থায় প্লাস্টার লাগিয়েছেন। সেটা দিয়েই হাতি হত্যার মামলা থেকেও জামিন পেতে চাচ্ছিলেন তিনি।
এদিকে, রামুর খুনিয়াপালংয়ের ধোয়াপালং এলাকার মৃত আলী হোসেনের ছেলে নজির আহমেদ, স্ত্রী শাহেদা আক্তার, নজিরের ছেলে তৈয়ব আলী, আয়ুব আলী ও মোহাম্মদ আলম সহ ওই এলাকার বাকি সাত আসামীকে মামলার 'অজ্ঞাত সহযোগী' বলে উল্লেখ্য করা হয়েছে।
রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণয় চাকমা বলেন, "বমের ভেতর মানুষের আবাস বাড়ায় বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য নষ্ট হয়েছে। এরমাঝে নৃশংসভাবে কোন হাতিকে হত্যার ঘটনা এটাই প্রথম দেখেছি। এটার যথোপযুক্ত শাস্তি হলে অন্যরা এমন কাজ করতে ভয় পাবে আশা করছি"।
হাতির প্রতি অত্যাচার বন্ধে জনপ্রতিনিধিদের সজাগ থাকার অনুরোধ করেছে উপজেলা প্রশাসন। খুনিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল মাবুদ বলেন, "নিরীহ বন্য প্রাণীকে হত্যা কোনমতে মানা যায় না। আমরা পাহাড়বেষ্টিত ইউনিয়নগুলোতে হাতিসহ বন্যপ্রাণী রক্ষায় পরিষদের উদ্যোগে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চালানোর পরিকল্পনা নিয়েছি। এসব বন্যপ্রাণী আমাদের সম্পদ। এদের রক্ষার দায়িত্বও আমাদের"।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. হুমায়ুন কবির বলেন, "কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের হাতির উপদ্রবে এলাকায় অসংখ্য সভা, মাইকিং, লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি ইতোমধ্যে ১৬টি ইআরটি (এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম) গঠন ও প্রশিক্ষণ প্রদান করাসহ আরও ২০টি ইআরটি গঠনের কার্যক্রম চলমান আছে। পাহাড়ের এসব এলাকায় দেয়া বৈদ্যুতিক লাইন বিচ্ছিন্নকরণে ব্যবস্থা নিতে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে আবেদন জানানো হয়েছে। এসব বিষয় উল্লেখ করে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে লিখিত জানানো হচ্ছে। আমরা চাই হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব অচিরেই নিরসন হউক"।
ডিএফওর মতে, "এত হতাশার মাঝে আনন্দের বিষয় হলো, গত বছর দেড়েক সময়ে দক্ষিণ বনবিভাগের বন এলাকায় হাতির পালের সাথে বাচ্চা হাতির দেখা মিলছে। এসময়ে কমপক্ষে দশ থেকে বারটি বাচ্চা হাতি জন্ম নিয়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের"।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের ধোয়াপালং এলাকায় ধানক্ষেতে চলে আসা একটি মা হাতিকে ভোররাতের কোন একসময় বৈদ্যুতিক ফাঁদে ফেলে হত্যার পর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে হাতির মাথা, পাসহ শরীরের নানা অঙ্গ খণ্ড-বিখণ্ড করা হয়েছিল।পরে সেসব খণ্ডিত প্রত্যঙ্গ উদ্ধার করে বন বিভাগ। এ ঘটনায় একজনকে আটকের পর দুটি মামলা করা হয়েছে।