খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত ৯ জুট মিলে পাঁচ বছরে লোকসান ১৪৭৫ কোটি টাকা
ধারাবাহিক লোকসানের কবলে পড়েছে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত নয়টি জুট মিল। বিগত পাঁচ অর্থবছরে এই মিলগুলোতে লোকসান হয়েছে এক হাজার ৪৭৫ কোটি ৫৭ লাখ ১৫ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনের (বিজেএমসি) খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের নথি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
বিজেএমসির নথি থেকে জানা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত আলীম জুট মিলে লোকসান হয়েছে ৭১ কোটি ৬৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত কার্পেটিং জুট মিলে ৪৫ কোটি ৫৬ লাখ ১৪ হাজার টাকা, ক্রিসেন্ট জুট মিলে ৪৬৬ কোটি ১৫ লাখ ৯ হাজার টাকা, দৌলতপুর জুট মিল ৩৭ কোটি ৫১ লাখ ৯২ হাজার টাকা, ইস্টার্ন জুট মিলে ৮৯ কোটি ১৮ লাখ ৬২ হাজার টাকা, জেজেআই জুট মিলে ১৩০ কোটি ৮১ হাজার টাকা লোকসান হয়।
এ ছাড়া খালিশপুর জুট মিলে ১১৯ কোটি ৩৭ লাখ ৯ হাজার টাকা, প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলে ৩১৮ কোটি ৪০ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ও স্টার জুট মিলে ১৯৭ কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে পাঁচ অর্থবছরে।
কেন হচ্ছে লোকসান
রাষ্ট্রায়ত্ত জুট মিল সংশ্লিষ্টরা জানান, জ্যেষ্ঠ কর্তৃপক্ষের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাব, অব্যবস্থাপনা, সময়মতো কাঁচামাল কিনতে না পারা, উৎপাদনের কাজে অদক্ষ শ্রমিকের ব্যবহার ও শ্রমিক অসন্তোষ এবং দীর্ঘ প্রায় ৭০ বছরের পুরাতন মেশিনারিজ ব্যবহারের কারণে জুট মিলগুলোতে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন হচ্ছে না।
তারা জানান, ভরা মৌসুমে পাটের দাম কম থাকে। কিন্তু তখন বিজেএমসি পাট কেনে না। দাম বাড়ার পর তারা মাঠে নামে। অন্যদিকে বিপণন বিভাগের অদক্ষতার কারণে পাটপণ্যের দাম কম মেলে। ফলে পাটজাত পণ্য অবিক্রিত থাকে।
প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলের শ্রমিক মিজানুর রহমান বলেন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাহিদামতো কাঁচা পাট সরবরাহ না করার কারণে মিলগুলোতে লোকসান হচ্ছে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মুরাদ হোসেন বলেন, বিজেএমসি পাট কেনার মৌসুম শেষে এক হাজার ২০০ টাকা মণের কাঁচা পাট কেনে এক হাজার ৯০০ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায়। সময়ের পাট অসময়ে কিনতে গিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজেএমসির একজন কর্মকর্তা বলেন, পাটক্রয় মৌসুমে চাহিদামতো পাট কিনতে না পারা এবং অদক্ষ শ্রমিকদের উৎপাদন কাজে ব্যবহারের কারণে মিলগুলোকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। তার ওপর দীর্ঘ ৭০ বছরের পুরাতন মেশিনারিজ দিয়ে চাহিদামতো উৎপাদন করা আর সম্ভব নয়। এ ছাড়া প্রশাসন ও শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় সময়ই সাংঘর্ষিক অবস্থা থাকার কারণে মিলগুলোর উৎপাদন বিঘ্নিত হয়।
তিনি জানান, প্রতি বছর মিলগুলোর জন্য পাট কেনা বাবদ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে শুধু খুলনা অঞ্চলের ৯টি জুট মিলের জন্যই দরকার প্রায় ৬০০ কোটি টাকার পাট। সেখানে কেনা হয়েছে মাত্র ১০০ কোটি থেকে ১৫০ কোটি টাকার পাট। তাও এই পাট কেনা হয়েছে বাকিতে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত তিন বছর সরকার কাঁচা পাট ক্রয়ে মিলগুলোতে কোনো টাকা বরাদ্দ দিতে পারেনি, যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে মিলগুলোতে।
তিনি বলেন, সরকারি পাটকলে উৎপাদনশীলতা কম। সরকারি পাটকলে এক টন চটের বস্তা তৈরিতে গড়ে ৯০ জন শ্রমিক লাগে। বেসরকারি মিলগুলো একই পরিমাণ পণ্য উৎপাদনে শ্রমিক ব্যবহার করে ২৫ থেকে ৩০ জন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজেএমসির খুলনা অঞ্চলের সমন্বয়ক (লিয়াজোঁ কর্মকর্তা) বনিজউদ্দীন মিঞা বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো ঠিকমতো চালু রাখতে হলে প্রথমেই পাটকলগুলোর সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধান করাসহ পাটক্রয় মৌসুমে চাহিদা অনুযায়ী পাটক্রয় করতে হবে। যেখানে যেখানে যে ধরনের দক্ষ লোকের প্রয়োজন, তাদের সেখানে নিয়োগ দিতে হবে। এ ছাড়া শ্রমিকদের সময়ভিত্তিক মজুরি বাতিল করে পিচরেট (কাজ না করলে কোনো মজুরি পাবে না) ভিত্তিতে কাজ করাতে হবে।
তিনি বলেন, দীর্ঘ প্রায় ৭০ বছর আগের পুরাতন মেশিনারিজ (যন্ত্রাংশ) দিয়ে আর পাটকলগুলো সঠিকভাবে চালু রাখা সম্ভব নয়। দীর্ঘ দিনের পুরাতন মেশিনারিজের পরিবর্তে চতুর্থ জেনারেশনের মেশিনারিজ দিয়ে মিলগুলো চালানো গেলে সেগুলোকে অবশ্যই লাভজনক করা সম্ভব।