শ্রীলঙ্কার আমদানির অর্থ ফুরিয়ে আসছে ডেল্টা মোকাবেলায়
শ্রীলঙ্কার ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক বিনিময় রিজার্ভ দেশটির জন্য চরম সংকট তৈরি করেছে। বিশ্লেকদের মতে, সংকট সামলে উঠতে দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রকে আরও কঠোর নীতি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বেলআউট ফান্ডের জন্যও আবেদন করতে হতে পারে।
গত জুলাই মাসে রিজার্ভ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশধের পর সরকারের কাছে অবশিষ্ট যা রিজার্ভ ছিল, তা দিয়ে দুই মাসের আমদানি খরচও মেটানো সম্ভব ছিল না। দেশটি বিদেশ থেকে গম, চিনি ও গুঁড়ো দুধ আমদানি করে থাকে। তবে এ বছর শ্রীলঙ্কার রুপির মূল্যমান ৭.৩ শতাংশ কমে যাওয়ায় আমদানি খরচ বেড়ে গেছে; ফলে মুদ্রাস্ফীতিও তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শঙ্কিত হয়ে মানুষ পণ্য কিনে মজুদ করতে শুরু করেছে, যা নতুন ধরনের সংকট সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সিঙ্গাপুরের লম্বার্ড ওডিয়ারের বাজার বিশ্লেষক নিবেদিতা সুনীল বলেন, 'বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি একটি শঙ্কার বিষয়; কখন না, তাদের এফএক্স রিজার্ভ ফুরিয়ে যায়। বন্ডগুলো দিয়ে কোথায় ব্যবসা করা হচ্ছে যদি আপনি লক্ষ্য করেন, তাহলে স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারবেন, তারা আর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে না।'
শুক্রবার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মাসের ২৩ তারিখে আইএমএফ-এর 'স্পেশ্যাল ড্রউয়িং রাইটস' মার্কিন ডলারে রূপান্তরের ফলে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩.৫৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল।
গত ৭ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে পার্লামেন্টে জানিয়েছেন, করোনা মহামারির জন্য নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে সরকার তার রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারেনি। কোভিড-১৯ এর তৃতীয় ধাক্কা মোকাবেলায় পুরো দেশজুড়ে সরকার নানা ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করাসহ বেসরকারি মিল থেকে চালের মজুদ পর্যন্ত জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া, নীতিনির্ধারকরা লকডাউন বাড়িয়েছেন, সুদের হার বাড়িয়েছেন, আমদানি সীমিত করেছেন এবং ব্যাংকগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রা ঋণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
অন্যদিকে,কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ওয়েলিগামেজ ডন লক্ষণ আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করবেন বলেও জানা গেছে।
শ্রীলঙ্কায় আইএমএফ মিশন প্রধান মাসাহিরো নোজাকি জানিয়েছেন, আইএমএফ শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তার অনুরোধ পায়নি। তিনি একটি ই-মেইলে লিখেছেন, 'অনুরোধ করা হলে আমরা বিকল্প পথগুলো নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত। আমরা শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ও নীতিগত উন্নয়ন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।'
পর্যটন খাতে ধস
ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্পকে মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দেশটির অর্থনীতির প্রায় ৫ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মোকাবেলায় লকডাউন বাড়ানোর ফলে বাণিজ্য ও শিল্প আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ সপ্তাহে পার্লামেন্টে রাষ্ট্রপতি গোতাবায়ে রাজাপাকসে সংকট মোকাবেলায় বেশ কিছু জরুরি ব্যবস্থা পাস করেছেন। ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে একটিতে মেজর জেনারেল এন.ডি.এস.পি. নিওয়ানহেল্লাকে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় খাদ্য সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
তবে বিরোধী আইনপ্রণেতারা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা হিসেবে এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, বিদ্যমান আইনের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবেলা করা যেতে পারে।
এদিকে, নতুন নিয়মগুলো দ্রুতই কার্যকর করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বুধবার সরকারি মূল্য-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীনে শস্য বিতরণের জন্য কর্মকর্তারা পলোনারুয়া জেলার একটি মিল থেকে চালের মজুদ জব্দ করেছেন এবং মিলের বিরুদ্ধে শস্য মজুদ করে রাখার অভিযোগও আনা হয়েছে।
ব্যাংক ঋণ
দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেন আশঙ্কাজনকভাবে কমে না যায়, মূলত এ কারণেই বছরের শুরুতে মূলধন নিয়ন্ত্রণের উপরে এই পদক্ষেপগুলো কর্যকর করা হয়েছে। এছাড়া রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য সরকার ব্যাংক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরকে ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
আইএমএফ গত আগস্ট মাসে চীন ও বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কাকেও 'স্পেশ্যাল ড্রউয়িং রাইটসে'র মাধ্যমে তহবিল সরবরাহ করেছে। বিশ্বব্যাপী তারল্য বৃদ্ধির জন্য আইএমএফ সংকটে পড়া দেশগুলোকে এই সুবিধা দিয়ে থাকে। সিঙ্গাপুরে বিএনপি পরিবাস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সিনিয়র পোর্টফোলিও ম্যানেজার এক পন টয়ের মতে, আইএমএফ-এর দেওয়া তহবিল সুবিধা অন্তত এ বছরের শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার ডলারের চাহিদাকে পূরণ করতে সক্ষম হবে; সেইসঙ্গে এটি জানুয়ারিতে বন্ড পরিশোধেও সহায়তা করবে।
তিনি আরও বলেন, 'তবে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং পর্যটন খাতে মহামারির প্রভাব বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পূরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।'
ফিচ সলিউশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে মোট ৩.৬ বিলিয়ন ডলার।
মুদ্রা রিজার্ভের ক্রমহ্রাসমান পরিস্থিতি এবং ৬ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার লক্ষ্য সীমায় পৌঁছতে হিমশিম খাচ্ছে; আর বিনিয়োগকারীরা আরও খারাপ পরিস্থিতির জন্য ইতোমধ্যেই নিজেদের প্রস্তুত করতে শুরু করেছেন। এর মাঝে গত ১৯ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপ্রত্যাশিতভাবে সুদের বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১৮ সালের পর প্রথমবারের মতো সুদের হার বাড়তে দেখা গেলো দেশটিতে। এর কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, কম সুদে ঋণ সুবিধা দেওয়ার কারণে দেশে রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেড়েছে, যা বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি করছে।
ব্লুমবার্গ সূচক অনুযায়ী, গেল আগস্টে সুদের হার বৃদ্ধির ফলে শ্রীলঙ্কার ডলার কিছুটা ক্ষতি সামলে নিয়ে মাসিক ২.৯ শতাংশ হারে লাভ করতে শুরু করেছে, যা পুরো এশিয়ায় সর্বোচ্চ। তবে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে বৃদ্ধির এই হার যথেষ্ট নাও হতে পারে।
লম্বার্ড ওডিয়ারের সুনীল বলেন, 'সরকারের উচিত একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের দিকে যাওয়া। আর আমাদের দৃষ্টিতে, এটি আইএমএফ-এর প্রোগ্রাম ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।'
-
সূত্র: ব্লুমবার্গ