৫৪৩ দিন পর খুললো আনন্দের দুয়ার
মহামারির করাল অভিঘাতে দেড় বছর আগে যে শঙ্কা আর ভয় নিয়ে বন্ধ হয়েছিলো শ্রেণিকক্ষগুলো; তার বিপরীতে আনন্দ আর উৎসবের বাতাবরণ নিয়ে ৫৪৩ দিন পর খুললো সেগুলোর দুয়ার।
কখনো আংশিক, কখনো কঠোর লকডাউনের বন্দিদশা আর প্রতিমাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সরকারি প্রেস রিলিজের পর্ব পেরিয়ে স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরলো বাংলাদেশের স্কুল-কলেজগুলো।
শিক্ষার্থীদের জীবনে যে কয়টি উৎসবের দিন আছে, নিঃসন্দেহে তার মধ্যে আজকের দিনটি যোগ হলো বিশেষ একটি দিন হিসেবে। সংক্রামক রোগের প্রাণঘাতি এই ভাইরাসটি পৃথিবীকে থমকে দেওয়ার আগে, নগর কিংবা গ্রামের, কিংবা পাহাড়ি কোনো রাস্তার পথ ধরে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে ইউনিফর্ম পরা শিক্ষার্থীদের যে হেঁটে যাওয়া; তা বাংলাদেশ দেখলো বহুদিন পর।
সরকারের ১৯ দফা দিকনির্দেশনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা উৎসব আমেজে আজ তাদের শ্রেণীকক্ষে ফিরেছে। প্রায় দেড় বছর পর স্কুল কলেজের আঙিনায় পা রেখে শিক্ষার্থীদের যেন বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস। স্বাস্থ্যবিধির নানা বিধি-নিষেধের মধ্যেও স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিয়েছে ফুল দিয়ে। বেলুন কিংবা কাগুজে অরিগ্যামিতে সাজানো শ্রেণিকক্ষে ঢুকেই শিক্ষার্থীদের উল্লাস; প্রিয় সহপাঠী ও শিক্ষকদের সঙ্গে দীর্ঘ দেড় বছর পর দেখা। শিক্ষার্থীদের কাছে দিনটি ছিল 'ঈদের আনন্দের' মতোই।
শ্রেণীকক্ষে ফেরার আজকের উৎসব দেখে নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়। প্রথম স্কুলে যাওয়ার আগের রাতে বিছানায় বালিশের কাছে স্কুল ইউনিফর্ম আর বই নিয়ে না ঘুমিয়ে পার করা সে রাত! দীর্ঘদিন পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেরার আমেজটা নিঃসন্দেহে আজকে সকল শিক্ষার্থীদের জন্য এমন উত্তেজনাকরই কেটেছে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে অজানা এই ভাইরাসের মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া।
বাংলাদেশে ২০২০ সালের ১৮ এপ্রিল অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর গত ১৭ মাসে মোট ২২ বার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা –ইউনেসকো জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দীর্ঘতম সময় স্কুল বন্ধ রাখার রেকর্ড গড়ে। গত বছরের মার্চ থেকে এ মাসের শুরু পর্যন্ত, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সময় যাবত বন্ধ ছিল বাংলাদেশের স্কুলগুলো।
জাতিসংঘ জরুরি শিশু তহবিল - ইউনিসেফের তথ্য মতে, মহামারি চলাকালে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘ এই সময়ে শিশুরা বেশি সময় স্কুলের বাইরে থাকায় সহিংসতা, শিশুশ্রম এবং বাল্যবিবাহের মতো বিষয়গুলোর জন্য তাদের স্কুলে ফিরে আসার সম্ভাবনা কমতে থাকার বার্তাও দিয়েছিল সংস্থাটি।
তবুও করোনাভাইরাসের নিম্নমুখী সংক্রমণের মধ্যে দীর্ঘ দেড় বছর পর সরকারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। কারণ একটাই। যাদের হাতে আগামীর বাংলাদেশ, সেই শিক্ষার্থীরা স্কুলে ফিরেছে।
করোনা সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসার পর শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে সরকার যে ১৯ দফা দিক নিদের্শনা দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সকলকে বাধ্যতামূলক মাস্ক পড়া, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিকিৎসা কেন্দ্র বা আইসোলেশন কেন্দ্র নির্মাণ করা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ইত্যাদি। দেশীয় বাস্তবতায় সেগুলো কতোটা মানা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে কক্ষ অপরিষ্কার থাকায় শিক্ষামন্ত্রী কর্তৃক আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করার বিষয়টি স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সরকারের জোর প্রচেষ্টার বার্তাই দিচ্ছে।
করোনা মাহামারি মোকাবিলায় আমাদের প্রথম বিজয় হচ্ছে সংক্রমণ কমিয়ে এনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারা। অনেকেই মনে করে এতো দীর্ঘদিন কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল! তার উত্তর দুটি- এক. করোনা সংক্রমণ থেকে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা; অর্থাৎ তাদের জীবন বাঁচানো। দুই. মানব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। একটি দেশের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সামরিক নিরাপত্তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি আধুনিক সমাজে বেসামরিক বা মানব নিরাপত্তা আরো বেশি জরুরি।
শিক্ষা মানুষের যেমন মৌলিক অধিকার তেমনি শিক্ষা অজর্ন করতে গিয়ে যখন শিক্ষার্থীদের মহামারিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে সে অবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু রাখা মানব নিরাপত্তা লঙ্ঘন করে। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অবশ্যই অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছে। তবে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাও জরুরি।
যেসকল দিক নিদর্শনা দিয়ে সরকার স্কুল কলেজগুলো খুলে দিয়েছে আশা করা যায় খুব শীঘ্রই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও শতভাগ টিকার আওতায় এনে খুলে দেয়া হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। ছোটদেরকে নিয়ম মেনে শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসাটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। প্রথম বাধা যেহেতু আমরা পার হতে পেরেছি, আশা করি পরবর্তী সব বাধাই সহজে উৎরাতে পারবো।
- লেখক: শিক্ষক, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়।