সিলেটে ২৩৯ রেলক্রসিংয়ের মধ্যে ১৬৭টির অনুমোদন নেই, প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা
রেলপথের ওপর দিয়ে গেছে গ্রামীণ সড়ক। আর সেই সড়ক দিয়েই চলাচল করছেন মানুষ। নিয়মিত যানবাহন যাওয়া-আসা করলেও নেই কোনো গেটম্যান। সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায় এই দৃশ্য।
কেবল এই একটি রেলপথই নয়, সিলেট বিভাগের ২৩৯ রেলক্রসিংয়ের মধ্যে বেশিরভাগের একই অবস্থা। কর্তৃপক্ষ বলছে, সিলেটের ১৬৭টি ক্রসিংয়েরই অনুমোদন নেই।
কয়েকটি রেলক্রসিং সরেজমিনে দেখা যায়, অনুমোদনহীন এসব রেলক্রসিংয়ে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছে মানুষ ও যানবাহন। এতে বাড়ছে রেল দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
গত রোববার দুপুরে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা এলাকার হোসেনপুরের কাছে রেলক্রসিং পাড়ি দিতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে যায় একটি মাইক্রোবাস। এতে দুজন যাত্রী নিহত ও একই পরিবারের ছয়জন আহত হন। যে রেলক্রসিংয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে সেটিও অনুমোদনহীন ছিল।
রেলওয়ের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো সংস্থা বা কোনো কর্তৃপক্ষকে রেললাইনের ওপর দিয়ে সড়ক তৈরি করতে হলে রেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ক্রসিংয়ের উভয় পাশে গেট নির্মাণসহ রেল কর্তৃপক্ষের কাছে ১০ বছরের জন্য কমপক্ষে তিনজন গেটরক্ষীর মজুরি মজুদ রাখতে হয়।
পরবর্তীতে, মাঠ পর্যায়ের পরিদর্শন শেষে রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণের পর রেলস্টেশন থেকে ওই ক্রসিংয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়।
তবে সিলেট বিভাগে এমন সড়ক তৈরিতে মানা হচ্ছে না এ নিয়ম। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এসব সড়ককে অবৈধ বা অনুমোদনবিহীন বললেও বন্ধ করতে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। গ্রামীণ সড়ক বাড়ার সঙ্গে দিনদিন এমন অরক্ষিত ক্রসিং বেড়েই চলছে।
কেবল রোববারের ওই দুর্ঘটনা নয়, সিলেট-আখাউড়া রেলপথে রেলক্রসিংয়ের ওপর প্রায়ই এমন দুর্ঘটনা ঘটে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, অনুমোদনহীন এসব সড়ক বন্ধ করে দিলেও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে স্থানীয় বাসিন্দারা পুনরায় তা চালু করে। ফলে, চেষ্টা করেও এসব সড়ক স্থায়ী ভাবে বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
রেলওয়ে সিলেট বিভাগের রেলপথ প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা যায়, সিলেট বিভাগে (সিলেট থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রেলপথ) মোট রেলক্রসিং রয়েছে ২৩৯টি। এরমধ্যে মাত্র ৭২টি রেলক্রসিং বৈধ। বাকি ১৬৭টিই অবৈধ। অনুমোদন ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণভাবে এগুলো গড়ে উঠেছে।
শহরতলীর কয়েকটি অনুমোদনহীন রেলক্রসিং ঘুরে দেখা গেছে যে, 'সাবধান, সামনে রেল পারাপার, সামনে রেলপথ, ধীরে চলুন, সামনে রেল ক্রসিং' ইত্যাদি লেখা সাইনবোর্ড টানানো থাকলেও এসব রেল ক্রসিংয়ের একটিতেও নেই সিগন্যালম্যান।
রেলপথ প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, অবৈধ ১৬৭টি রেল ক্রসিংয়ের মধ্যে সিলেট জেলায় ৫৩টি, মৌলভীবাজার জেলায় ৪২টি, হবিগঞ্জ জেলায় ৫৯টি, সুনামগঞ্জ জেলায় রয়েছে ১৩টি। কোনোরকম অনুমোদন ছাড়াই স্থানীয় বাসিন্দারা চলাচলের জন্য এসব ক্রসিং রাস্তা গড়ে তোলেছেন।
রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, "অনুমোদনহীন রেল ক্রসিংয়ের মধ্যে যেগুলো আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে, সেসব ক্রসিংয়ের অনুমোদন দিয়ে সিগনালম্যান দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।"
তিনি বলেন, "এরকম অনেক গেট আছে, যা আমরা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে স্থানীয় বাসিন্দারা এগুলো পুনরায় চালু করেছে।"
এদিকে, কুলাউড়ার ভাটেরা এলাকার হোসেনপুর পর্যন্ত অনুমোদনহীন ক্রসিং বেশি বলে জানায় ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষ।
এই স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মনির হোসেন বলেন, "ফেঞ্চুগঞ্জ ও মাইজগাঁওয়ে ছয়টি ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে দুটো অনুমোদিত। বাকি চারটির কোনো অনুমোদন নেই। এরপর ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে কুলাউড়ার ভাটেরা পর্যন্ত পথে পথে রেলক্রসিং। গ্রামীণ সড়ক গিয়ে যেখানে রেলপথে মিলিত হয়েছে, সেখানেই তা ক্রসিং হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।"
সিলেট রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক মো. খলিলুর রহমান বলেন, "গত বছর রেলওয়ের প্রকৌশল (পথ) বিভাগের এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সিলেট থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ২৩৯টি রেলক্রসিং রয়েছে। এর বেশিরভাগেরই কোনো অনুমোদন নেই।"
তিনি বলেন, "রেলপথের আশপাশে সড়ক হওয়ায় যেখানে-সেখানে রেলক্রসিং তৈরি করা হচ্ছে, যেগুলোর কোনো অনুমোদন নেই। এভাবে ক্রসিং তৈরির কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।"