ব্যয়বহুল শহর কক্সবাজারে স্থানীয়দের নাভিশ্বাস
পর্যটন শহর কক্সবাজারকে ‘ব্যয়বহুল’ শহর হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপন জারির ফলে এই এলাকার সরকারি চাকরিজীবীদের বাড়িভাড়াসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। ব্যয়বহুল এলাকাগুলোয় সরকারি চাকরিজীবীরা মূল বেতনের ৫০ শতাংশ বাড়িভাড়া পেয়ে থাকেন। কক্সবাজারে বর্তমানে এ হার ৪৫ শতাংশ। প্রজ্ঞাপন জারির পর কক্সবাজারের চাকরিজীবীরাও ৫০ শতাংশ পাবেন। বাড়বে টিএ-ডিএসহ অন্যান্য সুবিধাও।
স্থানীয়রা বলছেন, পর্যটক ও রোহিঙ্গাদের বাড়তি চাপের কারণে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার চাহিদা বেড়ে গেছে। বেড়েছে টাকার প্রবাহ। ফলে বেড়ে গেছে মূল্যস্ফীতির হার। ক্ষয় বেড়েছে টাকার। এতে স্থানীয় চাকরিজীবী ও স্বল্প আয়ের লোকজন বিপাকে পড়েছেন। তাদের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু সেভাবে আয় বাড়েনি। এতে জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে তাদের আপস করে চলতে হচ্ছে। এসব মানুষগুলোকে জীবন ধারণে সামনের দিনগুলোতে এক প্রকার যুদ্ধ করতে হবে বলে অভিমত স্থানীদের।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদ নেতা নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, ব্যয়বহুল শহরের প্রজ্ঞাপন হবার পর সরকারি চাকরিজীবীদের সুবিধা বাড়লেও চরম বেকায়দায় পড়েছেন স্থানীয়রা। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে অনেকে নিজেদের আশ্রয়স্থল হারিয়েছেন। তাদের সেবা দিতে কক্সবাজার ও উখিয়া-টেকনাফে এসেছে শতাধিক এনজিওর কয়েক হাজার কর্মী। এদের মধ্যে অনেক বিদেশিও রয়েছেন। বহিরাগত এতসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর আবাসন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বাড়ায় বাসাভাড়াসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে অশিক্ষিত, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন আয়ের বেসরকারি কর্মজীবীরা চরম বেকায়দায় জীবনযাপন করছেন। সরকারি কর্মচারীরাও একইভাবে ভোগান্তি সইলেও এখন প্রজ্ঞাপন তাদের অসুবিধা দূর করবে। কিন্তু আরও ভোগান্তিতে পড়বেন স্থানীয় নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন আয়ের বেসরকারি পেশাজীবীরা।
কক্সবাজার শহরে ভাড়া বাসায় থাকা রাসেল চৌধুরী বলেন, নব্বই দশকের শুরুতে শিক্ষা জীবন থেকে কক্সবাজারে বসবাস। তখন শহরের ভিআইপি এলাকা বাহারছরায় সর্বোচ্চ বাসা ভাড়া ছিল পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। গত পাঁচ বছর আগেও ভাড়াটা আট থেকে দশ হাজার টাকায় ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের শেষের দিকে হু হু করে বাড়ছে বাড়ি ভাড়া। শহরের যে এলাকায় মানসম্মত বাসা তিন হাজার টাকায় ভাড়া হতো এখন সেসব বাসার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার।
তিনি আরও বলেন, সরকারি কর্মজীবী বা এনজিও কর্মী ছাড়া এসব বাসায় স্থানীয় অধিবাসীদের থাকা অসাধ্য। এরপরও এতদিন আইনের দোহাই দিয়ে বেসরকারি চাকুরে, ক্ষুদ্র বা মাঝারি ব্যবসায়ীরা একটি সহনীয় পর্যায়ে ভাড়াটা পরিশোধ করতেন। কিন্তু এখন প্রজ্ঞাপনের দোহাই দিয়ে বাসা মালিকরা আর কম ভাড়া নিতে চাইবে না। ফলে অনেককে অতিসহসা তাদের দীর্ঘদিনের আবাসন ছাড়তে হবে।
একই কথা বলেন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা শাহনেওয়াজ। তিনি বলেন, গত এক বছরে বাড়িওয়ালা তিনবার বাড়ি ভাড়া বাড়িয়েছেন। আবার ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ পেয়ে সম্প্রতি অন্যবাসায় উঠেছি। শুধু বাসা ভাড়া নয়, ভোগ্যপণ্যও আগুন লাগা দামে কিনতে হচ্ছে। বলতে গেলে নাভিশ্বাস অবস্থায় সময় পার করছি।
আন্তর্জাতিক ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার-বাংলাদেশ (আইডিআরসি-বি)’র সি-সেইফ প্রজেক্ট ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমদ বলেন, ১২০০ স্কয়ার ফুটের একটি বাসায় ১৫ বছর আগে ছয় হাজার টাকা ভাড়ায় উঠেছিলাম। এখন সেটার ভাড়া দিতে হচ্ছে ২৪ হাজার টাকা। আমার আশপাশের অন্য ফ্ল্যাটগুলোর ভাড়া ৩০ হাজার টাকার বেশি।
শুধু বাসা ভাড়া নয়, ভোগ্যপণ্য নিয়েও চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন স্থানীয়রা। একটি আবাসিক হোটেলে কর্মরত রিয়াদ ইফতেখার বলেন, বাহারছরায় নিজেদের বাসায় থাকি। এরপরও জীবন যাপনে বেগ পেতে হচ্ছে। পর্যটন এলাকা হিসেবে বিগত অর্ধযুগ আগে থেকে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়তি গুণতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘‘উৎপাদন স্থলে যে আলু ৮-১০ টাকায় বিক্রি হয় সেই আলু এখানে কিনতে হয় ২৫-৩০ টাকায়। একটি কলা কিনতে হয় আট থেকে ১০ টাকায়। এভাবে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়তি। বাড়তি গুণতে হয় রিকশাসহ অন্যান্য যানের ভাড়াও। কিন্তু আয় আমাদের আগের মতোই।’’
সূত্রমতে, কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ২০১৭ সালের শেষ দিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি চিঠি দেয়। এতে বলা হয়, কক্সবাজার পর্যটন শহর। এখানে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক পর্যটক আসেন। ছুটির দিনগুলোতে ১০-১২ লাখ পর্যটক অবস্থান করেন এখানে। ছুটির দিন ছাড়া বিশেষ করে পর্যটন মৌসুমে বা শীতের সময় ৬-৮ লাখ পর্যটক থাকেন। অন্য সময়ে থাকেন দুই থেকে আড়াই লাখ পর্যটক। এসব কারণে এখানে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্য একটু বেশি। ফলে খাবার বা পরিবহন বাবদ বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়। যেটা অন্যান্য জেলায় করতে হয় না। এ কারণে তারা কক্সবাজারে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়তি ভাতা দেয়ার দাবি জানান।
এ ছাড়া গতবছর জেলা প্রশাসক সম্মেলনে কক্সবাজারের ডিসি আবারও প্রস্তাব তুলেন ব্যয়বহুল শহর ঘোষণার। সম্মেলনে কক্সবাজারের ডিসি বলেছিলেন, বাস্তুচ্যুত হয়ে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের আসার পর সেখানে দেশি-বিদেশি অসংখ্য বেসরকারি সংস্থা কাজ শুরু করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা সেখানে কাজ করছে। এর ফলে কক্সবাজারে থাকা-খাওয়ার খরচ বেড়ে গেছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর আর্থিক চাপ পড়ছে। এ বিবেচনায় কক্সবাজার শহরকে ব্যয়বহুল শহর ঘোষণার প্রস্তাব করেন তিনি। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দেন। পরে অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করে এখন প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। এখন অর্থ বিভাগ আর্থিক বিষয়গুলো নির্ধারণ করবে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজারের বাড়িভাড়া আগের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে। বেড়েছে অন্যান্য খরচও। একারণেই ব্যয়বহুল শহর ঘোষণার প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম।
বর্তমানে দেশের সাতটি বিভাগীয় শহর ছাড়াও কয়েকটি এলাকা সরকারি হিসেবে ব্যয়বহুল। সাত বিভাগ হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও রংপুর। ময়মনসিংহ বিভাগ হলেও এখনো ব্যয়বহুল শহর হিসেবে ঘোষণা হয়নি। এ ছাড়া ঢাকার পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জ জেলা, গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা এবং সাভার পৌর এলাকাও সরকারি হিসাবে ব্যয়বহুল এলাকা।