ভুট্টা বদলেছে চরবাসীর ভাগ্য
সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর চর খাসরাজবাড়ী। গত কয়েক বছর ধরে এই চরের প্রায় ৯০০ হেক্টর জমিতে ধান, ভুট্টা, পাট, মরিচ, গম, কালাই, বাদামসহ কিছু সবজিরও চাষ হচ্ছে। তবে কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, ভুট্টার আবাদ এই চরে ‘বিল্পব’ ঘটিয়েছে। স্থানীয় কৃষকরাও তাই মনে করেন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) বগুড়া ও সুইস ডেভেলমেন্ট কো-অপারেশন (এসডিসি) যৌথভাবে ছয় বছর মেয়াদি ‘মেকিং মার্কেটস ফর দি যমুনা, পদ্মা এন্ড তিস্তা চরস’ (এমফোরসি) প্রকল্পের আওতায় চাষিদের আধুনিক পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষের প্রশিক্ষণ দেয়। প্রশিক্ষণ পাবার পর অনেক এলাকাতেই দুই গুণেরও বেশি ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে। তারা এখন দামও পাচ্ছেন ভাল।
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এ চরের কিছু অংশ এখনো নদীতে থাকলেও আড়াই হাজার হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে ভুট্টার চাষ হচ্ছে প্রায় ৭০০ হেক্টর জমিতে। তবে বিপণন সমস্যার কথাও বলছেন চাষিরা। তারা জানান, এ সমস্যার সমাধান হলে তারা কৃষিপণ্যের দাম আরও ভাল পাবেন।
স্থানীয় পীরগাছা বাজারে এ চরের পণ্য বেচা-কেনা হয় সবচেয়ে বেশি। সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার মূল ভূ-খণ্ড মেঘাইঘাট থেকে চরে পৌঁছাতে নৌকায় সময় লাগে দুই ঘণ্টা। সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়ির পথ আরও প্রায় এক কিলোমিটার।
চরের কৃষি ও বিপনন ব্যবস্থা নিয়ে কথা হয় পীরগাছা বাজারের অন্তত ৩৫ জন কৃষকের সঙ্গে। তাদের একজন সিদ্দিক হোসেন (৬০)। প্রায় দুই হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করেন তিনি। সিদ্দিক জানান, প্রতি বছর বন্যায় অনেক জমি পানিতে তলিয়ে যায়। বন্যার পানির সঙ্গে আসা পলি জমে চরের মাটির উর্বরতা বাড়ে। এতে কৃষক বেশ লাভবান হন, কৃষি পন্যের ফলনও ভালো হয়।
কম খরচে চরে ভালো ফলন পাওয়ার কথা জানালেন মকবুল হোসেন। তার ভাষ্য, চরে এখন ভুট্টা চাষে খরচ খুবই কম। সারও লাগে অল্প। লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরা অন্য ফসলের চেয়ে ভুট্টার দিকে বেশি ঝুঁকছেন। ‘আরডিএ-এর শেখানো চাষাবাদের কৌশল ভাগ্য বদলে দিয়েছে তাদের।’ বলেন ভুটা চাষি মকবুল হোসেন।
তিনি বলেন, পাঁচ বছর আগেও চরে এক হেক্টর জমিতে ভুট্টা হতো গড়ে সাড়ে ছয় টন। কিন্তু এখন ভুট্টার উৎপাদন হচ্ছে দ্বিগুণের বেশি। প্রতি হেক্টরে প্রায় সাড়ে ১৩ টন। তবে চাষিদের অভিযোগ, তাদের পণ্য বিক্রির জায়গা কম, যোগাযোগের ব্যবস্থাও ভাল নয়।
রিনা খাতুনের স্বামী শহিদুল ইসলাম একজন দিনমজুর। চার ছেলে-মেয়ে তাদের। বড় মেয়ে বগুড়ার একটি সরকারি কলেজে লেখাপড়া করছেন। সংসারের সচ্ছ্বলতার জন্য স্বামীর সঙ্গে রিনাও মাঠে কাজ করেন। শহিদুল চাষাবাদ করেন। রিনা বীজ বপন করেন।
রিনা বলেন, ভুট্টা চাষের জন্য অনেক কষ্ট করে ০.৪ হেক্টর জমি ইজারা নিয়েছি। গত বছর ওই জমি থেকে মাত্র পাঁচ টন ভুট্টা পেয়েছি। বিক্রিও করেছি। তবে বাজার যাচাই করার কোনো সুযোগ পাইনি। কাজীপুর বাজারে তখন প্রতিমণ ভুট্টা ৬০০ টাকা করে বিক্রি হলেও না জানার কারণে আমরা এই চরে ৫০০ টাকা মণ বিক্রি করেছি। উৎপাদন বাড়লেও আমরা ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি।
এই চরে উৎপাদিত পণ্যগুলো বাজারজাতের সমস্যার কথা উঠে এসেছে আরও অন্তত ২০ জন চাষির মুখে। তারাও চান, চরের সঙ্গে বড় কয়েকটি কোম্পানীর সংযোগ ঘটুক। তাহলে তারা বাজার যাচাই করে চরেই তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারবেন।
কাজীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, এই চরের প্রায় ৭০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়। গড় ফলন হেক্টরে ১২ টন। ভুট্টা চাষীদের কাছ থেকে যে হিসাব পাওয়া গেছে তাতে বছরে ভুট্টা পাওয়া যায় গড়ে আট হাজার ৪০০ টন।
এ চরের পূর্ব দিকে যমুনা নদী পার হলেই ময়মনসিংহ জেলা, দক্ষিণ-পশ্চিমে কাজীপুর এবং উত্তর-পূর্বে বগুড়ার সারিয়াকান্দির বোহাইল ইউনিয়ন। যমুনা নদীর মাঝখানের খাসরাজবাড়ী এই চরে ভাঙা-গড়া চলছে গত ১৯ বছর ধরে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠ সবুজের সমারোহ। কৃষকরা কাজে ব্যস্ত। এখন মাঠে ধানের আবাদ বেশি থাকলেও এই চরে ভুট্টার চাষে বেশি আগ্রহ কৃষকদের। চরে ভুট্টার আবাদে সচ্ছলতা এসেছে অন্তত দেড় হাজার পরিবারের।
সিরাজগঞ্জ জেলা বিপণন কর্মকর্তা আইয়ুব আলী বলেন, চরের জীবনমাণ বদলে গেছে। অনেকের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। সব চরের বাজার ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তবে এখনো কোনো পরিকল্পনা সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়নি।
স্থানীয় চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, কৃষকদের জীবনমাণ উন্নয়নে বিভিন্ন সময় সভা-বৈঠক করা হয়। তবে বাজার ব্যবস্থা বা যোগাযোগ নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, কয়েকটি চরে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনের বিষয়টি মাথায় রেখে কাজীপুর মেঘাই ঘাট এলাকায় একটি হোলসেল মার্কেট তৈরির খসড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে কথা হয়েছে। ওই কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলে কৃষকদের আয় অন্তত ২০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব। এতে চরের অর্থনীতি আরও সচল হবে।