মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় পুলিশের 'উত্তর' আসে না!
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বর্তমান কমিশন মেয়াদে সেপ্টেম্বর,২০১৯ থেকে ডিসেম্বর,২০২০ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে মোট ৩৬ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। এসব অভিযোগের বেশিরভাগই পুলিশের বিরুদ্ধে। তবে প্রায় দুই বছর সময় পেরিয়ে গেলেও এসব বিষয়ে এখনো কোন 'উত্তর' আসেনি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২০ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার বিকেলে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের কাছে মানবাধিকার কমিশনের ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে দিবেন কমিশন চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষমান থাকা বর্তমান কমিশন মেয়াদে, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় ০৭টি, কারাগারে মৃত্যুর ঘটনায় একটি, বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনায় ০৩টি, মিথ্যা মামলা দেয়ার অভিযোগে ০৩টি ও অন্যান্য ৯টিসহ শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে মোট ৩৬টি অভিযোগের প্রতিবেদন বা উত্তর চাওয়া হয়েছে। এদিকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন জানিয়েছেন, এই ৩৬টি অভিযোগের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদের কাছে এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে, যার একটি অনুলিপি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেও পাঠানো হয়েছে। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে এখন পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তর থেকে কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।
বর্তমান কমিশনের মেয়াদের দুই বছরের বাইরেও, কমিশন প্রতিষ্ঠার পর ২০১২ থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় মোট ৮৩টি অভিযোগের বিপরীতে এখনো কোন উত্তরই আসেনি। এসব অভিযোগের মধ্যে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় ১৪টি, বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনায় ১২টি, নিখোঁজ/গুমের ঘটনায় ২৫টি, নির্যাতনের ঘটনায় ১৮টি, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ০৩টি ও আরো ১১টি অভিযোগে পুলিশের কাছে প্রতিবেদন চাইলেও দীর্ঘ নয় বছরেও এখনো কোন সদুত্তর আসেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, এসব অভিযোগের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে পুলিশের আইজিপির কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে মাত্র ১২টি অভিযোগের বিপরীতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রতিবেদন পাঠানো হলেও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে তা সন্তোষজনক হয়নি বলে বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ১২টি অভিযোগের বিষয়ে আবারো প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি দিলেও উত্তর দেয়নি পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশ কেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের বিষয়ে প্রতিবেদন দেয় না এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সদর দপ্তরের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (মিডিয়া) হায়দার আলী খান ও সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. কামরুজ্জামানের কাছে বক্তব্য জানতে চাইলে তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক টিবিএসকে বলেন, তার মেয়াদে তিনি দুই বার রাষ্ট্রপতির কাছে বার্ষিক প্রতিবেদনের সাথে আলাদা মেমোরেন্ডাম দিয়ে এ বিষয়ে সুরাহা চেয়েছেন।
"এটা তো রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার বিষয়, অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ কেন প্রতিবেদন পাঠাবে না। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে তো অবশ্যই দ্রুত পাঠাতে হবে, আমার মেয়াদেও তারা কিছু কিছু ঘটনায় প্রতিবেদন পাঠাতো ঘটনার অনেক বছর পর। পুলিশ অভিযোগের বিষয়ে উত্তর দেয় না, এমন তথ্য বিদেশে একটি সম্মেলনে উপস্থাপনের পর তারা আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল। পুলিশ কেন মানবাধিকার কমিশনের কথা শুনবে না," যোগ করেন তিনি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, "পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযোগের প্রতিবেদন পাঠানোর বিষয়ে এই কমিশনের মেয়াদে আন্তরিক হয়েছে, বলতে পারেন আগের সময়ের চাইতে প্রতিবেদন পাঠানোর হার ভালো"।
পুলিশ ও অনান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন অভিযোগের উত্তর দেয় না সে বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (প্রশাসন) কাজী ফারহান আশিক টিবিএসকে বলেন, "এর সঠিক কারণ আমাদের জানা নেই। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনে বাধ্যবাধকতা থাকায় আমরা শুধু প্রতিবেদন চাইতে পারি, তবে সে প্রতিবেদন কতদিনের মধ্যে দিতে হবে তার কোন বাধ্যবাধকতা নেই"।
"চাইলে কমিশন নিজে স্বপ্রণোদিত হয়ে পুলিশসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করতে পারেনা, শুধু প্রতিবেদন চাইতে পারে। এ কারণে আইন সংশোধন করার জন্য খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে আইনমন্ত্রী ও কমিশন চেয়ারম্যান বৈঠকও করেছেন, মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে আন্তরিক। একই সাথে কমিশনের একটি বিধিমালাও তৈরি হয়ে যাবে," বলেন কাজী ফারহান আশিক।
নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারে না মানবাধিকার কমিশনও
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ এর ২২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, প্রতি বছর ৩০ মার্চের মধ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এর আগের বছরের সার্বিক কাজের বিষয়ে 'বার্ষিক প্রতিবেদন' প্রকাশ করবে ও প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করবে। তবে খোদ মানবাধিকার কমিশন নিজেই প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোন বছরই ৩০ মার্চের আগে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেনি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (প্রশাসন) কাজী ফারহান আশিক বলেন, "২০১৯ ও ২০২০ সালের প্রতিবেদন আমরা ঠিক সময়েই প্রস্তুত করে রেখেছিলাম, প্রকাশ করতে পারিনি। এ বছর এপ্রিলে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে তুলে দেয়ার জন্য তারিখ নির্ধারণ করা থাকলেও সম্ভব হয়নি। তবে আমরা এরই মধ্যে ২০২১ সালের প্রতিবেদনও গুছিয়ে ফেলেছি। আশা করছি আগামী বছর ঠিক সময়েই প্রকাশ করা হবে"।
একই সাথে আইনে বলা আছে, প্রতিবেদনের সাথে একটি স্মারকলিপি থাকবে যাতে অন্যান্যদের মধ্যে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কোন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে তার করার কারণ কমিশন যতদূর অবগত থাকবে ততদূর লিপিবদ্ধ থাকবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়েও বার্ষিক প্রতিবেদনে তেমন কিছু উল্লেখ করা হয়নি।