এপিআই উৎপাদনকারীদের জন্য ২০৩২ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি সুবিধা আসছে
ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর অব্যাহতি সুবিধা বাড়াতে যাচ্ছে। ওষুধের কাঁচামাল সাধারণত অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট (এপিআই) এবং ল্যাবরেটরি রিএজেন্ট নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের তথ্য মতে, বর্তমানে ফার্মা কোম্পানিগুলোতে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার কাঁচামালের চাহিদা রয়েছে। যা প্রতি বছর গড়ে ১২ শতাংশ হারে বাড়ছে। তবে, ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার কাঁচামাল স্থানীয় প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া যায়।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, স্থানীয়ভাবে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন ও ব্যবসায় কর অব্যাহতির সুবিধা ২০২২ সাল পর্যন্ত রয়েছে। তবে এখন কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এর মেয়াদ ২০৩২ পর্যন্ত বাড়ানো প্রস্তাব অর্থমন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। গত সপ্তাহে এনবিআরের এই প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ও অনুমোদন করেছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এখন কর অব্যাহতির প্রস্তাবটি প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করতে আর কোন বাধা নেই।
এনবিআরের শর্তে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ কর অব্যাহতির সুবিধা পেতে হলে কোম্পানিগুলোকে প্রতি বছর ন্যূনতম পাঁচটি করে নতুন এপিআই মলিকিউল এবং ল্যাবরেটরি রিএজেন্ট স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করতে হবে। আর যেসব প্রতিষ্ঠান ন্যূনতম তিনটি পণ্য উৎপাদন করবে তাদের ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে করপোরেট কর দিতে হবে।
তবে, কেউ যদি ন্যূনতম শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থ হয় তাকে ৩০ শতাংশ হারে কর্পোরেট কর দিতে হবে এবং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের করহার হবে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ।
প্রস্তাবনায় আরো বলা হয়েছে, কোম্পানিগুলোকে বার্ষিক টার্নওভারের ন্যূনতম ১ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে উন্নয়ন ও গবেষণা কাজে ব্যয় করতে হবে। আর এই বরাদ্দ বছর বছর বাড়াতে হবে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি মানহীন কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক জরিমানার শিকার হয়, তবে ওই প্রতিষ্ঠান সেই বছরের অব্যাহতির সুবিধা পাবে না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার ন্যাশনাল অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট অ্যান্ড ল্যাবরেটরি রিএজেন্ট প্রোডাকশন অ্যান্ড এক্সপোর্ট পলিসি, ২০১৮ এর আলোকে ২০৩২ সালের মধ্যে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে।
এই নীতিমালার আলোকেই কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। এতে করে দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তারা এই খাতে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া এক চিঠিতে এনবিআর উল্লেখ করে এপিআই নীতিমালার সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে এই কর অব্যাহতি সুবিধা কার্যকর হলে স্থানীয়ভাবে পাঁচ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার কাঁচামাল উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন হবে। একইসঙ্গে এই খাতে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে।
এক্টিভ ফাইন কেমিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম সাইফুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলে, "২০৩৩ সাল থেকে বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পেটেন্ট অব্যাহতির সুবিধা পাবে না। তাই এই সময়ের মধ্যে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। এক্ষেত্রে এনবিআরের প্রস্তাব কার্যকর হলে অনেক দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তা এখানে বিনিয়োগে উৎসাহী হবে।"
এদিকে সরকার ২০০৮ সালে মুন্সিগঞ্জে এপিআই শিল্প পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এই পার্কে ২০০ একর জমিতে মোট ৪১টি প্লট করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৭টি প্রতিষ্ঠানকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাগেরহাট ও খুলনায় বেসরকারি উদ্যোগে এপিআই পার্ক করা হচ্ছে।
বিভিন্ন ওষুধের ক্ষেত্রে এপিআইয়ের খরচ ৩০ থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশ স্থানীয়ভাবে পূর্ণাঙ্গরূপে উৎপাদিত ৯৮ শতাংশ ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। পূর্ণাঙ্গরূপে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এপিআই ও অন্যান্য কাঁচামালের ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। কাঁচামাল আমদানিতে অধিক নির্ভরতার কারণে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে সাপ্লাই চেইন এবং মূল্য নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা কাজ করে।
বর্তমানে, স্কোয়ার ফার্মা, বেক্সিমকো ফার্মা, একটিভ ফাইন কেমিক্যালস লিমিটেড, এসিআই লিমিটেড, গ্লোব ফার্মা, গণস্বাস্থ্য ফার্মা, অপসোনিন ফার্মা, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল এবং এসকায়েফসহ স্থানীয় ১৫ টি প্রতিষ্ঠান ৪০ শতাংশ পর্যন্ত এপিআই উৎপাদন করে। এদের মধ্যে কেবল এক্টিভ ফাইন কেমিক্যালস লিমিটেড পুঁজিবাজারের অন্তর্ভুক্ত যা কোনো সম্পূর্ণ ওষুধ উৎপাদন করে না। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস একাই স্থানীয়ভাবে ৬০ শতাংশ এপিআই উৎপাদন করে।
আমেরিকান বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউভিআইএ-র মতে, দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল বাজারের মূল্য ২০২০ সালে ১০ শতাংশের বেশি বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার মেডিসিন রপ্তানিও করে থাকে। তবে, দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০টি প্রতিষ্ঠান মোট ওষুধের ৭১ শতাংশ বিক্রি করে।
২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণের পর ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ট্রেড-রিলেটেড এসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস (টিআরআইপিএস)-এর আওতায় পেটেন্ট ছাড়ের সুবিধা পেতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।