রপ্তানি পণ্য ও সরকারি প্রণোদনা
পণ্য রপ্তানিতে কেন ভর্তুকি বা সহায়তা প্রয়োজন?
রপ্তানি আয়ের বিপরীতে সরকার নগদে যে ভর্তুকি দেয়, তা-ই নগদ সহায়তা। ১০ শতাংশ নগদ সহায়তার মানে হলো, ১০০ টাকা রপ্তানির বিপরীতে রপ্তানিকারকেরা সরকারের কাছ থেকে ১০ টাকা পান। বৈশ্বিক রপ্তানি প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে সরকারকে নগদ সহায়তা দিতে হয়। বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ বেশি বলে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমানো যায় না। এ জন্য রপ্তানিকারকদের উদ্বুদ্ধকরণে নগদ সহায়তা দিতে হয়।
২০২১ সালের মধ্যে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলার সরকারিভাবে নির্ধারিত হওয়ায় এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণকল্পে নগদ ভর্তুকি বাড়াতে হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর রপ্তানি খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি ভর্তুকি খাতে ৬ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই ভর্তুকি আরও ৭.৬৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ গত চার বছর রপ্তানি খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ বাড়ছে।
এর বাইরে রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতি বছর বাজেটে কর ছাড়ের মতো সহায়ক নানারকম সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়।
রপ্তানিখাতে সরকারি প্রণোদনা ও বাস্তবতা
সরকারের ভর্তুকি, প্রণোদনা বা নগদ আর্থিক সহায়তা ছাড়া দেশের রপ্তানি খাত এগোতে পারছে না। অনেক খাত বছরের পর বছর নগদ সহায়তা পেয়েও টেকসই হচ্ছে না; আবার তৈরি পোশাকসহ কিছু পণ্য রপ্তানি খাত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেও বিশেষ সুবিধা নেওয়ার অভ্যাস পরিহার করতে পারছে না।
রপ্তানি বাড়ানোর জন্য উৎসাহ দেওয়ার পেছনে রপ্তানি খাতে নগদ আর্থিক সহায়তা দেওয়ার এই প্রবণতা প্রতি বছরই বাড়ছে। এভাবে রপ্তানি খাতে বছরের পর বছর চলছে ভর্তুকি বরাদ্দ।
তবে এই প্রণোদনা দিয়ে দেশের রপ্তানি খাতের খুব একটা উন্নতি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞমহল মনে করেন না। বরং সরকারের আর্থিক সহায়তার ওপর খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের অতি নির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে রপ্তানি খাতের সম্প্রসারণ, বহুমুখীকরণ ও গুণগত মানোন্নয়নে উদ্যোক্তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও ঝুঁকি মোকাবিলার নিজস্ব সক্ষমতা প্রকাশ পাচ্ছে না। এর প্রেক্ষিতে, দেশে টেকসই রপ্তানি খাত সৃষ্টি হওয়া নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
তারা বলেছেন, নগদ আর্থিক সহায়তা দিয়ে রপ্তানি আয় বাড়ানোর চেষ্টা মোটেও স্থায়ী সমাধান নয়। কারণ ব্যবসা হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। নিজের চেষ্টাতেই তা মেলে ধরতে হবে। সেখানে বছরের পর বছর কোনো খাত বা খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা প্রণোদনায় ভর করে চললে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতা হ্রাস পায়। এতে সরকারের প্রণোদনা দেওয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও ব্যহত হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান এ.এইচ.এম. আহসানের মতে, প্রতি বছরই নগদ অর্থ সহায়তার জন্য বিবেচিত রপ্তানি খাতগুলো পুনঃনির্ধারণ করা হয়। একইসঙ্গে প্রণোদনার শতকরা হারও পুনর্বণ্টন করা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪টি পণ্যকে নতুন করে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি একেবারেই নতুন, কোনো প্রণোদনা পেত না। আবার সম্ভাবনা ভালো, কিন্তু সুবিধা কম- এমন ১০টি খাতে প্রণোদনা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া এমন কিছু খাত আছে, যারা বহু বছর ধরে পাচ্ছে, তাদের অনুকূলে প্রণোদনার হার প্রতি বছর কমিয়ে আনা হচ্ছে।
করোনা মহামারি: এনেছে নুতন অপ্রচিলত পণ্য ও তার রপ্তানির সুযোগ
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি রপ্তানি খাতে কিছু সম্ভাবনাও নিয়ে এসেছে। রপ্তানি তালিকায় যুক্ত করেছে নতুন কিছু পণ্য। ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণের (পিপিই) চাহিদা বেড়েছে বিশ্বে। বেড়েছে মাস্কের ব্যবহার। মাস্ক ছাড়াও চাহিদাসম্পন্ন পণ্যের মধ্যে আছে মেডিকার্ট রোবট এবং জীবাণুনাশক রিমোট কন্ট্রোল ইউভি-সি সিস্টেম, ভেন্টিলেটর বা অক্সিজেন সরবরাহকারী যন্ত্র, ফেস প্রটেকটিভ শিল্ড, সেফটি গগলস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও থার্মোমিটার। বর্তমানে ঢাকা ও তার আশপাশে সাভার ও গাজীপুরের ৩৩টি কারখানায় তৈরি হচ্ছে পিপিই ও ফেসিয়াল মাস্ক।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের মে মাস পর্যন্ত মোট ১১ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার অর্থমূল্যের মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। করোনার ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দেশের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে। সামনে আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব ধরে রাখতে সরকার প্রচলিত পণ্যের প্রণোদনা বাড়ানোর পাশাপাশি এসব সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্যকে নগদ প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসার কথা ভাবছে।
রপ্তানিতে নগদ সহায়তা: পুনরায় বিবেচনা করে দেখার মতো কিছু দিক
নগদ সহায়তা দিয়ে রপ্তানি খাতকে দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই করা যায় না। এজন্য দরকার রপ্তানিবান্ধব শুল্কনীতি ও অনুকূল বিনিময় হার। আবার, নগদ সহায়তা পেয়ে অনেক সময় রপ্তানিকারকেরা উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করেন। ভারত বাংলাদেশের পাট পণ্য রপ্তানিতে যে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে, তার পেছনে এই নগদ সহায়তা দায়ী বলে বাণিজ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। এ ছাড়া কোনো দেশ পণ্য রপ্তানিতে ভর্তুকি দিলে আমদানিকারক দেশ বিপরীতে সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাউন্টারভেইলিং শুল্ক আরোপ করতে পারে।
কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান পণ্য রপ্তানি না করে রপ্তানি দেখিয়ে নগদ সহায়তার টাকা উঠিয়ে নিচ্ছে। আবার কম হারের কিংবা নগদ সহায়তার আওতা বহির্ভূত পণ্য রপ্তানি করে বেশি হারের পণ্য দেখাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই পণ্য কম রপ্তানি করে বেশি দেখিয়েও কারসাজির মাধ্যমে নগদ সহায়তার অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে কেউ কেউ। চট্টগ্রাম, ঢাকা কাস্টমস হাউসসহ অন্যান্য কাস্টমস হাউসে এ ধরনের কারসাজি ইদানিং ধরা পড়েছে।
এ ধরনের কারসাজি রোধ করতে পণ্য চালান পরীক্ষায় আরও সতর্ক হতে কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস। বিশেষত বাড়তি নগদ সহায়তার সম্পৃক্ততা রয়েছে, এমন পণ্য চালান এবং অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য চালান কায়িক পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিকতা যাচাইয়ের নির্দেশনা দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে বন্দরের বাইরে অফডকে পণ্য চালানের সংখ্যা ও অফডক কর্তৃপক্ষের কাছে রক্ষিত তথ্য যাচাই করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
শেষ কথা
সরকারের তহবিল থেকে রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তা দেওয়ায় অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব পড়ছে, সে বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কোনো সুনির্দিষ্ট গবেষণা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পরিচালিত হয়নি; কিন্তু তা হওয়া প্রয়োজন। কারণ, বাংলাদেশ বর্তমানে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে চলেছে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে একদিকে যেমন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা থেকে রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রাপ্ত সুবিধাদি থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে, অন্যদিকে তেমনি প্রণোদনা দিয়ে পণ্য রপ্তানিতে নেমে আসবে এন্টি-ডাম্পিং ও কাউন্টারভেইলিং নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া!
সুতরাং, রপ্তানি প্রণোদনা দেবার বিষয়ে আরেও সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন।
-
লেখক: ডেপুটি চিফ, বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়