কেন গরীব দেশগুলোকে টিকা দিতে আগ্রহ নেই মডার্নার?
বর্তমান বিশ্বে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে মডার্নার টিকাকে 'সেরা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা' হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ এই টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোকে অপেক্ষায় রেখে ধনী দেশগুলোকে দিয়ে যাচ্ছে তাদের টিকার সমস্ত চালান। বৈশ্বিক এই সংকটে তাদের এমন আচরণের মূলে রয়েছে 'মুনাফা'। ধনী দেশগুলোকে টিকা সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা অর্জনের বদলে তারা দরিদ্র দেশগুলোকে টিকা দিতে খুব একটা আগ্রহী নয়।
ভ্যাকসিন শিপমেন্ট ট্যাকিং নিয়ে কাজ করা ডেটা ফার্ম এয়ারফিনিটি-এর তথ্যমতে, মার্কিন সরকারের আর্থিক ও বৈজ্ঞানিক সহায়তায় যুগান্তকারী এই টিকাটি তৈরির পর, অন্য কোনো টিকা প্রস্তুতকারকের চেয়ে মডার্না তার ডোজের একটি বড় অংশ ধনী দেশে পাঠিয়েছে।
মডার্না টিকার প্রায় এক মিলিয়ন ডোজ বিশ্বব্যাংকের স্বল্প আয়ভুক্ত দেশগুলোতে পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে, ফাইজারের ৮.৪ মিলিয়ন ডোজ এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের প্রায় ২৫ মিলিয়ন একক-শট ডোজ একই দেশগুলোতে গেছে।
মধ্যম আয়ের যেসব দেশগুলো মডার্নার টিকা কেনার জন্য চুক্তি করেছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই এখনও টিকা পায়নি। এর মধ্যে আবার কমপক্ষে তিনটি এমন দেশও আছে, যাদের মডার্নার কাছ থেকে টিকা পাওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে বেশি অর্থ দিতে হয়েছে। সেসব দেশের সরকারি কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
থাইল্যান্ড এবং কলম্বিয়া অগ্রিম অর্থ দিয়ে রেখেছে। বতসোয়ানার ডোজ পেতে আরও দেরি হবে। এবং তিউনিসিয়া মডার্নার সঙ্গে যোগাযোগই করতে পারেনি।
ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ছাড়াও অন্যান্য ওষুধের ব্যবসা রয়েছে। তবে মডার্না করোনাভাইরাসের টিকা ছাড়া অন্য কোনো ওষুধের ব্যবসায় করে না। তাই এই কোম্পানির ভবিষ্যত মূলত করোনাভাইরাস টিকার বাণিজ্যিক সাফল্যের উপরেই নির্ভর করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের সাবেক প্রধান ড. টম ফ্রিডেন বলেন, "তারা এমন আচরণ করছেন যেন তাদের বিনিয়োগ থেকে সর্বোচ্চ আয় উঠিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব তাদের নেই।"
এদিকে, মডার্নার নির্বাহীরা বলেছেন, তাদের উৎপাদন ক্ষমতা সীমিত হওয়া সত্ত্বেও তারা যতটা সম্ভব বেশি টিকা উৎপাদনের যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। তবে, এ বছর তারা যে পরিমাণ টিকা উৎপাদন করবেন, তা সবই চলে যাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো ধনী দেশগুলোতে। কারণ টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে তাদের সঙ্গে আগেই চুক্তি করে রেখেছিল মডার্না।
মার্কিন প্রশাসনের দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দরিদ্র দেশগুলোতে টিকা সরবরাহে মডার্নার অনীহায় যুক্তরাষ্ট্রও হতাশ হচ্ছে। এমনকি মার্কিন প্রশাসন টিকা উৎপাদনে তাদের নিজেদের প্লান্টগুলোকে ব্যবহারের অনুমতিও দিয়েছে এবং বিদেশের বাজারে এই টিকা উৎপাদনের জন্য বাইরের কোম্পানিগুলোকেও প্রযুক্তির লাইসেন্স দেওয়ার জন্য মডার্নার নির্বাহীদের চাপ দিচ্ছে।
অন্যদিকে, ধনী দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার অভিযোগ উঠায় এর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার লড়াইয়ে নেমেছে মডার্না।
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহীরা উৎপাদন বাড়াতে আফ্রিকায় একটি কারখানা স্থাপনের কথা জানালেও, কখন এবং নির্দিষ্ট করে ঠিক কোথায় তা স্থাপন করা হতে পারে সে ব্যপারে এখনও কিছুই বলেননি।
মার্কিন প্রশাসনের দুই সিনিয়র কর্মকর্তা আরও জানান, দরিদ্র দেশগুলোতে টিকা বিতরণের উদ্দেশ্যে মডার্নার নির্বাহীরা বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করছে। যেহেতু ফাইজার ইতোমধ্যে এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে; তাই আশা করা যায় মডার্নাও এই মিশনে অংশ নেবে। তবে সেই আলোচনা এখনও চলমান।
শুক্রবার একটি সাক্ষাৎকারে, মডার্নার প্রধান নির্বাহী, স্টেফেন ব্যানসেল বলেন, "এটা দুঃখজনক" যে তার কোম্পানির টিকা দরিদ্র দেশগুলোতে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়নি; কিন্তু পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল।
পশ্চিমা দেশগুলোতে টিকাদান কর্মসূচী চালু হওয়ার প্রায় এক বছর পর, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিশ্বের অনেক জায়গায় টিকার তীব্র সংকটের চিত্র দেখা গেছে। এদের মাঝে বেশিরভাগই আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ, যেখানে গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০ শতাংশেরও কম জনসংখ্যাকে টিকা দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র চায় উগান্ডার মতো কম আয়ের দেশগুলোর জন্য মডার্না আরো ডোজ সরবরাহ করুক। কম্পালা ইতোমধ্যে ফাইজারের ডোজ পাওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছে।
গত বছর, ক্লিনিকাল ট্রায়ালের ফলাফলে দেখা গেছে, মডার্না এবং ফাইজারের টিকা সমানভাবেই কার্যকর। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মডার্নার ডোজ বেশি কার্যকর; এটি দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা প্রদান করে এবং এটি পরিবহন ও সংরক্ষণ করা সহজ।
মডার্না বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে তার সম্পর্কে জনসাধারণের কাছে খুব বেশি তথ্য নেই। তবে যেই ২২ টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মডার্নার চুক্তির খবর নিশ্চিত করা গেছে, তাদের মধ্যে এক ফিলিপাইন ছাড়া আর কোনো নিম্ন আয়ের দেশ নেই। এছাড়া, ছয়টি রয়েছে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ।
অন্যদিকে, ফাইজার জানিয়েছে, তারা ১২ টি উচ্চমধ্যম, পাঁচটি নিম্ন-মধ্যম এবং একটি দরিদ্র দেশ রুয়ান্ডার কাছে মূল্যছাড়ে টিকা বিক্রি করবে। তিউনিসিয়ায় ফাইজার তার প্রতি ডোজ প্রায় ৭ ডলারে বিক্রি করছে।
এর বিপরীতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মডার্নার প্রতি ডোজ বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে প্রায় সাড়ে ১৬ মার্কিন ডলারে। এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ২২ থেকে প্রায় সাড়ে ২৫ ডলারে।
আবার, বিশ্বব্যাংকের উচ্চমধ্যম আয়ের অন্তর্ভুক্ত বতসোয়ানা, থাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়ায় মডার্না তার প্রতি ডোজ বিক্রি করছে ২৭ থেকে ৩০ ডলারে।
অন্যান্য সরকার কতটা অর্থ প্রদান করছে সে সম্পর্কে স্বচ্ছতার অভাব তুলনামূলকভাবে দরিদ্র দেশগুলোকে দর কষাকষিতে দুর্বল অবস্থানে ফেলেছে। ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের পরামর্শক কেট এল্ডার বলেন, "তারা সম্পূর্ণ অন্ধকারে থেকে আলোচনা করছেন।"
তবে, ধনী দেশগুলোকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের পরে, কিছু দরিদ্র দেশকে মডার্নাও কমমূল্যে টিকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
সেই আলোচনার সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরের মে মাসে মডার্না আফ্রিকান ইউনিয়নকে প্রতি ডোজ টিকা প্রায় ১০ ডলারের বিনিময়ে দিতে চেয়েছে। তবে এই টিকা আগামী বছরের আগে পাওয়া যাবে না; ফলে আলোচনাটি আর বেশিদূর এগোয়নি।
টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান মডার্না আশা করছে, টিকা উৎপাদনের মাধ্যমে চলতি বছরে তারা কমপক্ষে ২০ বিলিয়ন ডলার আয় করবে, যা চিকিৎসা সামগ্রী ব্যবসায়ের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুনাফা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চলেছে। অথচ ২০১৯ সালে মডার্নার মোট আয় ছিল মাত্র ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এ বছর মডার্নার বাজার মূল্য প্রায় তিনগুণ বেড়ে ১২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হয়েছে। এছাড়া কোম্পানির দু'জন প্রতিষ্ঠাতার পাশাপাশি একজন বিনিয়োগকারী, এ মাসে ফোর্বস ম্যাগাজিন প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ৪০০ জন ধনী ব্যক্তির তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন।
বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে টিকা সরবরাহের জন্য জাতিসংঘের কোভ্যাক্স কর্মসূচিতে মডার্না চলতি বছর ৩৪ মিলিয়ন ডোজ এবং ২০২২ সালের মাঝে ৪৬৬ মিলিয়ন ডোজ টিকা সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু কোভ্যাক্সের একজন মুখপাত্রের মতে, কোম্পানিটি এখনও এই ডোজগুলোর কোনোটিই পাঠায়নি; যদিও কোভ্যাক্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দান করা মডার্নার কয়েক মিলিয়ন ডোজ দরিদ্র দেশগুলোতে বিতরণ করেছে।
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী ব্যানসেল বলেছেন, ২০২০ সালে দু'পক্ষ সরবরাহ চুক্তিতে পৌঁছালে এই বছর আরও অনেক ডোজ টিকা কোভ্যাক্সকে দেওয়া যেতো। অন্যদিকে, কোভ্যাক্সের একজন কর্মকর্তা অউরলিয়া গুয়েন তা অস্বীকার করে বলেন, '২০২১ সালে আমরা ন্যূনতম কিছু পরিমাণ ডোজ আশা করেছিলাম।"
গত বছরের শেষের দিকে, তিউনিসিয়া সরকার মডার্নার টিকা অর্ডার করতে চেয়েছিলেন। তবে দেশটির টিকা সংগ্রহের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দানকারী ডা হেকমি লুজির, মডার্নার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করবেন তা জানতেন না; ফলে তিনি তিউনিসিয়ায় মার্কিন দূতাবাসের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। সেখানকার কর্মকর্তারা মডার্নার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও, তা ফলপ্রসূ হয়নি বলে তিনি জানান।
ডা লুজির বলেন, "আমরা মডার্নার টিকার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলাম। আমাদের পক্ষ থেকে যথেষ্ট চেষ্টা আমরা করেছি।"
- সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস