মারিয়া রেসার নোবেল শান্তি পুরস্কার জয় কেন ফেসবুকের জন্য এক বড় ধাক্কা?
সাংবাদিক মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভের নোবেল শান্তি পুরস্কারলাভ বাক স্বাধীনতার বড় একটি বিজয়। বিশ্বজুড়েই সংবাদমাধ্যমের লাগাম টেনে ধরার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। ঠিক এমন সময় রেসা ও মুরাতভের অর্জন গণতন্ত্র রক্ষার চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমের সমালোচনাত্মক ভূমিকাকেই নতুন করে সামনে এনেছে। তবে রেসার জয়কে আরও একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার আছে, আর তা হলো ফেসবুকের ব্যর্থতা।
ফিলিপাইনের অন্যতম ভিন্নধারার পত্রিকা র্যাপলারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মারিয়া রেসা একসময় সিএনএনে সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নিউজ ওয়েবসাইট হিসেবে প্রকাশের পূর্বে ২০১১ সালে স্রেফ একটি ফেসবুক পেজ হিসেবে র্যাপলার যাত্রা শুরু করে। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতোই ফিলিপাইনের মানুষের জন্যও অনলাইন জগতে প্রবেশের অন্যতম প্রধান প্ল্যাটফর্ম হলো ফেসবুক। ফিলিপিনোদের জন্য ফেসবুক ইন্টারনেটের সমতুল্য এমন বক্তব্যও নতুন নয়।
রেসাকে প্রথম কথা বলতে শুনেছিলাম ফেসবুক নিয়ে। ফিলিপাইনে ফেসবুকের আধিপত্য বাড়ার সঙ্গে কীভাবে ফেসবুকের সামাজিক দায়বদ্ধতাও বেড়ে গেছে, সেটাই মার্ক জাকারবার্গকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ৯৭ শতাংশ ফিলিপিনো ফেসবুক ব্যবহার করেন বলে জাকারবার্গকে জানিয়েছিলেন রেসা। ফেসবুকের সঙ্গে যে সমস্যাগুলোর উদ্ভব ঘটছে তা ভালোমতো বোঝার জন্য তিনি জাকারবার্গককে ফিলিপাইনে আসার আমন্ত্রণ জানান।
মার্ক জাকারবার্গ সেই আমন্ত্রণ উপেক্ষা করেন বলেই মনে হয়েছিল। পরিবর্তে তিনি দেশটিতে ফেসবুকের প্রভাব আরও জোরদার করার দিকে মনোযোগ দেন। তিনি নাকি উল্টো প্রশ্ন করেছিলেন, "বাকি ৩ শতাংশ তাহলে কী করছে, মারিয়া?"
প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের উত্থানের পর থেকেই রেসা ফেসবুকের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনায় সরব হন। মিথ্যা তথ্য ছড়ানোতে ফেসবুকের সক্রিয় ভূমিকার পাশাপাশি তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে প্রভাব পর্যালোচনায় ফেসবুকের অনীহা নিয়েও সমালোচনা করেন। অথচ ফেসবুকের বৃহত্তম বাজার এই অ-পশ্চিমা দেশগুলো। তাদের ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই এসব দেশের বাসিন্দা। ভারতে হেট স্পিচ বা বিদ্বেষমূলক বার্তা নিয়ন্ত্রণে কিংবা মায়ানমারে জেনোসাইড ও সহিংসা ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্যও ফেসবুক তুমুল সমালোচনার সম্মুখীন হয়।
রেসা এবং তার র্যাপলারের নির্ভীক প্রতিবেদক দল দুতার্তের শাসনব্যবস্থায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বিরোধীদলকে ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে দুতার্তে ক্ষমতায় আসার পর রেসা বেশ কিছু ফেসবুক পেজ সামনে নিয়ে আসেন। এই পেজগুলো অন্তত ৩০ লাখ মানুষের কাছে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে। তিনি তার প্রমাণাদি ফেসবুকের কাছেও পাঠান। কিন্তু, ফেসবুক তা আমলে নেয়নি।
২০১৯ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে রেসা বলেন, "ফেসবুক এখন বিশ্বের বৃহত্তম সংবাদ বিতরণকারী। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা দ্বাররক্ষকের ভূমিকা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যখন তারা এই কাজ করে, যখন মিথ্যাকে সত্যের সঙ্গে মিশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, তখন সমগ্র জনপরিসরের জন্যই তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।"
দুতার্তে ও তার অনুগত দুর্বৃত্তদের হাতে নিপীড়নের শিকার রেসা ও তার দলকে রক্ষা করতেও ব্যর্থ হয় ফেসবুক। রেসা ও তার সহকর্মীরা অনলাইনে তীব্র আক্রমণ, সহিংসতার হুমকি ও যৌন আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তাদের গ্রহণযোগ্যতা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে ফেসবুক। দুতার্তের সমর্থকরাই এই তথাকথিত 'ট্রল আর্মিদের' সংগঠিত করেছিল। টাকার বিনিময়েও অনলাইনে তাদের হয়রানির আয়োজন করা হয়।
করফাঁকি কিংবা অনলাইনে মানহানির মতো ফৌজদারি অভিযোগে জড়ানোর পাশাপাশি রেসাকে থামাতে দুতার্তে সরকার অনলাইনেও ক্রমাগত হয়রানি করে যায়। জেলে রাত কাটানোর সঙ্গে রেসার স্বাধীনভাবে চলাফেরার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে দুতার্তে সরকার।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্টস অ্যান্ড ইউনেস্কো কর্তৃক চলতি বছর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ফেসবুকে রেসার পক্ষে প্রতিটি মন্তব্যের বিপরীতে তাকে আক্রমণ ও অপদস্ত করে মন্তব্য করেছে আরও অন্তত ১৪ জন। তাকে 'বেশ্যা' বলা থেকে শুরু করে ধর্ষণ ও শিরশ্ছেদের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। ফেসবুক কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।
অনলাইন ট্রল আয়োজনের মাধ্যমে দুতার্তে সরকারের এই নিপীড়নে স্পষ্ট সংযোগ থাকা সত্ত্বেও ফেসবুকের নিষ্ক্রিয়তা বিষয়টিকে আরও ভয়াবহ করে তোলে।
সাংবাদিকদের জন্য ফিলিপাইন বিশ্বের অন্যতম অনিরাপদ রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও পাবলিক ফিগার হওয়ায় ফেসবুক রেসাকে রক্ষা করতে খুব বেশি কিছু করতে পারবে না বলেও জানিয়ে দেয়। ফেসবুক আক্রমণাত্মক ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য অপসারণের দাবি করলেও তাদের অভ্যন্তরীণ নথিতে, রেসা কিংবা অন্যান্য পাবলিক ফিগারদের হত্যার হুমকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ফেসবুকের নিষ্ক্রিয়তার প্রমাণও মিলে। আর তাই রেসা ও তার সহকর্মীরাও বিরামহীনভাবে ভার্চুয়াল আক্রমণের শিকার হতে থাকেন। সেইসঙ্গে চলতে থাকে জনসাধারণকে প্রভাবিত করতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলা ফেক অ্যাকাউন্ট ও মূলধারার গণমাধ্যমের মিথ্যা প্রচারণা।
রেসা কিন্তু থেমে যাননি। নিপীড়ন, মামলা, সহিংসতার হুমকি সত্ত্বেও তিনি কাজ করে গেছেন। দুতার্তের শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলে সরকারকে তিনি চাপের সম্মুখীন করেছেন। তবে, দুতার্তের চেয়েও বৃহৎ, প্রভাবশালী এবং সম্ভবত আরও ভয়ঙ্কর যে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান নেন তা হলো ফেসবুক।
শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে রেসার সাহসিকতাকেই স্বীকৃতি দিয়েছে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি। কিন্তু, জননিরাপত্তা ও গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষত ফেসবুকের যে মুখোশ তিনি বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচন করেছেন, তার জন্যও তিনি এই সম্মাননার অংশীদার।
'ফেক নিউজ'- এই শব্দযুগলের ব্যবহার এখন মুখে মুখে। কিন্তু, রেসা আরও বহু আগেই মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এই দূরদৃষ্টির জন্যও তিনি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির দাবিদার।
মারিয়া রেসার নোবেল পুরস্কার কেবল মানবাধিকার রক্ষা এবং গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থানে সাংবাদিকতার ভূমিকার স্বীকৃতি নয়। এই পুরস্কার বিভ্রান্তিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ তথ্য প্রচার এবং নারী, প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে অনলাইন নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যর্থতাকেও চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়। ভ্রান্ত তথ্য শান্তিরক্ষায় হুমকিস্বরূপ। রেসাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে প্রচারিত এই বার্তা আমাদের সকলেরই মনে রাখা উচিত।
- সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট
- লেখক পরিচিতি: উইলসন সেন্টারের গ্লোবাল ফেলো নিনা জ্যানকোইজ অ্যালেথিয়া গ্রুপের বহিঃসংযোগ বিভাগের পরিচালক। তিনি 'হাউ টু লুজ ইনফরমেশন ওয়ার' এবং 'হাউ টু বি আ ওম্যান অনলাইন' বই দুটোর লেখিকা।
- ভাষান্তর: তামারা ইয়াসমীন তমা