বিশ্বজয়ের স্বপ্নে বিভোর বিস্ময়বালক সাদিদ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আপলোড করা একটি ভিডিওর বদৌলতে রীতিমতো তারকাখ্যাতি পাওয়া বিস্ময়বালক সাদিদ এখন বিশ্বজয়ের স্বপ্নে বিভোর। পেতে চায় প্রিয় ক্রিকেটারদেরও সঙ্গ।
মাত্র দুই বছর বয়সে বরিশাল সিটির আমানতগঞ্জে ক্রিকেটে হাতেখড়ি হওয়া সাদিদের বয়স এখন ছয়। পড়াশোনা করছে আমানতগঞ্জেরই উলালগুনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
সাদিদের ক্রিকেট অনুশীলনের শুরু হয় মামা সিরাজুল ইসলাম শুভর অধীনে। শুভ নিজে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করলেও, শুধু ভাগ্নের জন্য বরিশালের বাইরে চাকরির চেষ্টা করেননি।
সাদিদের ভুলভ্রান্তি খুঁজে বের করার আশায় শুভ তার খেলার ভিডিও ধারণ করেন এবং আগে থেকেই পরিচয় থাকা জাতীয় ক্রিকেটার শাহরিয়ার নাফিসের কাছে পাঠিয়ে দেন। নাফিসও শুভকে অনুপ্রাণিত করেন যেন শুভ তার ভাগ্নে সাদিদের অনুশীলন চালিয়ে যান। পাশাপাশি মাস দুয়েক আগে নিজের ফেসবুক ওয়ালে সাদিদের খেলার একটি ভিডিও আপলোডও করেন।
এরপর কিছুদিন আগে শুভ সাদিদের বোলিং অ্যাকশনের নতুন আরেকটি ভিডিও ধারণ করেন এবং ফেসবুকে আপলোড করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায় সেই ভিডিওটি। এমনকি বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার শচিন টেন্ডুলকার ও শেন ওয়ার্নও টুইটারে টুইট করেন সেটি। ফলে সাদিদের খ্যাতি ও পরিচিত এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।
কীভাবে এত অল্প বয়সেই ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ হলো সাদিদ? আসলে তার ক্রিকেটের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠার কাহিনিটা বেশ চমকপ্রদ। সেই কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার ও তার পরিবারের ব্যক্তিগত বেদনাদায়ক ইতিহাসও।
সাদিদের বাবা কাজ করতেন ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে। সাদিদের বয়স যখন সবে ছয় মাস, তখনই তিনি সাদিদ ও তার মাকে ছেড়ে চলে যান। তাই বুঝতে শেখার পর কখনো বাবাকে দেখেনি বা তার সান্নিধ্য পায়নি সাদিদ। বাবাকে ঘিরে কোনো স্মৃতিও নেই তার মনে।
ওই ছয় মাস বয়স থেকেই সাদিদ বাস করছে তার নানির বাসায়। তার বয়স যখন দুই বছর, তখন নানিই তার হাতে তুলে দেন প্লাস্টিকের ক্রিকেট ব্যাট ও বল। বাসার ভেতর একা একা অনুশীলন করতে থাকে সাদিদ। আর তার মামা শুভ তখন পড়াশোনা করছেন ঢাকায়।
কিন্তু শুভ যখন নিজের চোখে দেখতে পেলেন তার ভাগ্নের ব্যাটিং স্টাইল, তখন আর তার বিস্ময়ের অন্ত রইল না। তিনি বুঝতে পারলেন, অনুশীলন অব্যাহত রাখলে সাদিদের পক্ষে বড় ক্রিকেটার হওয়া সম্ভব।
"আমি নিজেও একজন ক্রিকেটার ছিলাম, বিভাগীয় পর্যায়ে খেলেছি। আমার স্বপ্ন ছিল একজন জাতীয় ক্রিকেটার হওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি," জানান সাদিদের সাফল্যের আশায় আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া শুভ।
তিনি আরও বলেন, "আমার নিজের যেহেতু ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাই আমি সহজেই আমার ভাগ্নের ক্রিকেটীয় দক্ষতার বিষয়টি ধরে ফেলি। খুব অল্প বয়স থেকেই সে ক্রিকেটীয় ব্যাকরণ মেনে খেলতে থাকে। বিশেষত শুরুর দিকে সে ছিল একজন ব্যাটসম্যান।
"এখন আমি স্বপ্ন দেখছি, আমার ভাগ্নে একদিন বাংলাদেশ দলে খেলবে। তবেই আমার স্বপ্ন পূরণ হবে।"
শুভ আরও জানান, শহরের বাইরে চাকরির কোনো চেষ্টা করেননি তিনি। তার কাছে এখন সাদিদের অনুশীলনই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এবং সেটিই নিশ্চিত করতে চান তিনি। "এলাকায় প্রাইভেট টিউশন করে আমি টাকা আয় করি, এবং সেই টাকা খরচ করি ভাগ্নের ক্রিকেট খেলার পেছনে।"
বছর তিনেক আগে নিজেদের বাসার ডাইনিং রুমে শুভর কাছে শুরু হয় সাদিদের আনুষ্ঠানিক অনুশীলন। সেই ঘটনার কথা স্মরণ করে শুভ বলেন, "শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ব্যাটিং প্রাকটিস করছিল সাদিদ। ফলে বল লেগে ঘরের অনেক জিনিসই সেদিন ভেঙে চুরমার হয়।"
বেশ কিছুদিন চলে মামা-ভাগ্নের 'ঘরোয়া' অনুশীলন। ঘরের দরজা লক করে তারা মধ্যরাত পর্যন্তও অনুশীলন করতে থাকেন। শুরুর দিকে শুভ চিন্তাই করতে পারেননি সাদিদ বোলার হিসেবে ভালো করতে পারবে। কিন্তু সাদিদের মনোজগৎ দারুণভাবে প্রভাবিত হয় বাংলাদেশ জাতীয় দলের তারকা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের মাধ্যমে।
"একটি ক্রিকেট ম্যাচ দেখে সাদিদ খুবই অনুপ্রাণিত হয় যেখানে সাকিব আল হাসান ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন। অথচ ওই ম্যাচে ব্যাট হাতে খুব একটা ভালো করতে পারেননি সাকিব। তখন সাদিদ আমার কাছে জানতে চায়, ব্যাটিংয়ে বেশি স্কোর না করেও সাকিব কীভাবে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার পেলেন। আমি সাদিদকে জানাই, সাকিব ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন তার অসাধারণ বোলিংয়ের কারণে। তিনি একজন অলরাউন্ডার," শুভ বলেন।
তখন থেকেই সাদিদ ঠিক করে ফেলে, সে-ও সাকিবের মতো একজন অলরাউন্ডার হবে।
"শুরুতে আমি ভাবছিলাম সাদিদ কী ধরনের বল করা শেখানো যায়। তারপর আমি মনস্থির করে ফেললাম। তাকে বললাম লেগ স্পিন ও গুগলি শিখতে। আমি তাকে দেখালাম বোলিংয়ের জন্য কী ধরনের হাতের কাজ দরকার। সে সেটা অল্প সময়ের মধ্যেই আয়ত্ত করে ফেলে। তারপর থেকে সে বোলিং প্রাকটিস শুরু করে, এবং এখন সে বোলিং ও ব্যাটিং দুটোর প্রাকটিসই করছে।"
আর দশটা অল্পবয়সী বাচ্চার মতো সাদিদও বোলিং অনুশীলনে বেশিরভাগ সময়ে টেপ টেনিস বলই ব্যবহার করে। তবে আসল ক্রিকেট বল দিয়ে অনুশীলনের অভিজ্ঞতাও তার রয়েছে।
সাদিদকে একজন 'কুইক লার্নার' অভিহিত করে শুভ বলেন, "আমি আশা করিনি সাদিদ এত অল্প সময়ের মধ্যে এত ভালো পারফর্ম করতে পারবে। কিন্তু সে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছে।"
শুভর ইচ্ছা, ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত সাদিদকে কোচিং করাবেন তিনি।
কথা হয় স্বয়ং বিস্ময়বালক সাদিদের সঙ্গেও। অকপটে নিজের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করে সে, "আমি সাকিব আল হাসান ও ভারতীয় ক্রিকেটার বিরাট কোহলির স্টাইল দেখে ব্যাটিং প্রাকটিস শুরু করেছি। আমি যদি ভালো খেলতে পারি, তাহলে সাকিব ও বিরাটের সঙ্গে দেখা করতে পারব।"
নিজের বোলিং শৈলীর বর্ণনা দিয়ে সাদিদ বলে, "আমি বল টার্ন করাতে পারি। আমার বোলিং দিয়ে ব্যাটসম্যানদের বোকা বানানোটা উপভোগ করি। ব্যাটসম্যানরা আমার বল বুঝতে পারে না। প্রায়ই তারা বোকা বনে যায়।"
সাদিদ জানায়, ইতোমধ্যেই স্থানীয় টুর্নামেন্টে পাঁচটি শতক হাঁকিয়েছে সে। এছাড়া এক ম্যাচে চার উইকেটও পেয়েছে।
"আমার স্বপ্ন বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলোয়াড় হওয়া, বিশ্বকাপ বাংলাদেশে নিয়ে আসা," বলে সাদিদ। সে আরও জানায়, তার মামাই একমাত্র কোচ যিনি তাকে প্রতিদিন লম্বা সময় ধরে অনুশীলনে সাহায্য করেন।
প্রায়ই নিজেদের বাসার পাশের স্কুল মাঠে অনুশীল করে সাদিদ ও তার মামা। তবে সাদিদের অনুযোগ, মাঠটি অনেক ছোট।
এদিকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করলেও, সাদিদের ব্যাপারে যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে তার নানি শিউলি আক্তারের। ক্রিকেট খেলা নিয়ে সাদিদের প্রতি প্রায়ই বিরক্ত হন জানিয়ে তিনি বলেন, "আমার নাতি বাসার মধ্যে ক্রিকেট খেলে আমাকে বিরক্ত করত। এখনও সে প্রায়ই শোকেস ও পানির গ্লাস ভেঙে ফেলে। একবার ঘরের মধ্যে প্রাকটিস করার সময় হাতে বল লেগে আমি বেশ আঘাতও পেয়েছিলাম।"
ভবিষ্যতে সাদিদকে বড় করতে কতটা সংগ্রাম করতে হবে উল্লেখ করে তার নানি বলেন, "ছেলেটা তার বাবার কোনো ধরনের সাহায্য পায় না। তাকে বড় করতে আমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হবে।"
সাদিদের মা জুমাতুন্নেসাও ছেলের ক্রিকেট খেলাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখেন না। ছেলের ক্রিকেট খেলার ব্যাপারে আপত্তিও জানিয়েছেন তিনি, কিন্তু খুব একটা লাভ হয়নি। তিনি বলেন, "আমি চেয়েছিলাম আমার বাচ্চাকে পড়াশোনা শেখাতে। কিন্তু পড়াশোনা বা স্কুলের ব্যাপারে সে একদমই আগ্রহী নয়। সে শুধু চায় ক্রিকেট খেলতে।"
সাদিদের অনুশীলনের সঙ্গী রাব্বি বলে, "ক্রিকেটের ব্যাপারে সাদিদ খুবই আন্তরিক ও একনিষ্ঠ। যদি সে কোনো ম্যাচে খেলে, তবে যেকোনো সময়ে ম্যাচের ফল বদলে দিতে পারে।"
ইতোমধ্যেই সাদিদের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছেন বরিশালের ফরচুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) দল ফরচুন বরিশালেরও মালিক।
"একজন ক্রিকেটার হিসেবে সাফল্য লাভের জন্য আমি তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে আগ্রহী। ছেলেটি আমাদের গর্ব ও সম্পদ," মিজানুর বলেন।