লিলিটেইলর: নারীদের পোশাক খাতে ভিন্নধারার সংযোজন
ফ্যাশন সচেতন রাফিনা তাবাসসুম একসময় দর্জির কাছে পোশাক বানানো ছেড়েই দিয়েছিলেন। কারণ বাইরে ঘুরে ঘুরে দর্জির দোকানের খোঁজ করা, জামার মাপ দেওয়া ছিল তার কাছে এক মহা ঝামেলা।
"কাপড় কেনা থেকে শুরু করে বানাতে দেওয়া, দর্জিকে আমার পছন্দের নকশা বুঝানো- এই সবকিছু আমার কাছে এক প্রকার যন্ত্রণাই মনে হতো। কিন্তু লিলিটেইলর আমাকে সেই ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছে। পোশাক বানানোর এক নতুন ধারণা তুলে ধরেছে আমার সামনে। এখন আমাকে শুধু পোশাকের নকশাটা কল্পনা করতে হয়, বাকিটা লিলিটেইলরই সামলে নেয়", বললেন রাফিনা।
রাফিনার মতো আরও অনেক নারীই পোশাক বানাতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হন। কারো হয়তো দর্জিবাড়ির খোঁজ করার সময় মেলে না, কারো বা স্থানীয় দর্জিদের কাছে কাপড় বানাতে অস্বস্তি। এই সব সমস্যার সমাধান নিয়ে এসেছে 'লিলিটেইলর'।
লিলিটেইলর 'লিলি'র একটি অঙ্গসংগঠন এবং একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যেখানে নারী ক্রেতারা তাদের চাহিদামাফিক পোশাক বানানোর সেবা পেয়ে থাকেন। পোশাক বানানোর কাপড় ও অনুষঙ্গের পাশাপাশি ক্রেতারা চাইলে তৈরি পোশাকও কিনতে পারেন লিলিটেইলর থেকে।
বাংলাদেশের টেইলরিং শিল্পে এখনও পুরুষদের আধিপত্য বেশি এবং তাদের সেবার মানও গড়পড়তা ধরনের। আর এখানেই ব্যতিক্রম আনার চেষ্টা করেছে লিলিটেইলর।
যেভাবে কাজ করে লিলিটেইলর
লিলিটেইলর একটি নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের অধীনে থাকা সব স্থানীয় দর্জিকে তালিকাভুক্ত করে এবং তাদের মধ্যে কাজ বণ্টন করে।
লিলি'র ফেসবুক পেজ বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কাপড় বানানোর জন্য বুকিং দিতে পারেন ক্রেতারা। তাদের অধীনে কর্মরত নারী স্টাফরা ক্লায়েন্টদের বাড়ি বাড়ি যায় এবং মাপ-নকশা সংগ্রহ করে। ক্লায়েন্টরা চাইলে পোশাকের কাপড় নিজেরাই দিতে পারেন। পুরো প্রক্রিয়াটি একেবারেই সহজ ও ঝামেলামুক্ত।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের সহযোগী অধ্যাপক তাজবিয়া করিম জানালেন কেন তিনি স্থানীয় দর্জিদের চাইতে লিলিটেইলরকে বেশি প্রাধান্য দেন।
তাজবিয়া বলেন, "একজন কর্মজীবী নারী হিসেবে আমার পক্ষে দর্জির দোকানে ঘোরা বেশ কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ। লিলিটেইলর আমার জীবনকে সহজ করেছে। স্থানীয় দর্জিদের সেবা সন্তোষজনক নয়, তারা অপেশাদার আচরণ করে এবং সময়মতো ডেলিভারি দেয় না। কিন্তু এখন আর সেসব নিয়ে ভাবনা নেই আমার।"
যেভাবে যাত্রা শুরু
২০১৭ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই সদস্য, সৈয়দ মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ (সাইফ) 'লিলি' প্রতিষ্ঠা করেন। তবে শুরুতে এটি ছিল একটি রাইড শেয়ারিং অ্যাপ। ২০১৮ সাল থেকে টেইলরিং সেবা যুক্ত হয় এখানে।
ছাত্রাবস্থায় একটি ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সিতে পার্ট-টাইম কাজ করতেন সাইফ। সেখানে তার কাজ ছিল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রেতাদের নানা জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়া।
এজেন্সিতে সাইফের বস তাকে একজন উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা দেন এবং শেষ পর্যন্ত গ্রাহকসেবাকেন্দ্রিক উদ্যোগই চালু করেন সাইফ।
নারীদের পোশাক সেবা খাতে একটি অদ্বিতীয় প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠাই লিলিটেইলরের লক্ষ্য। তাই অংশীদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সাথে বাছাই করে লিলিটেইলর।
স্টার্ট-আপ উদ্যোগে লাভের প্রসঙ্গে সাইফ বলেন, "আমরা আয়ের খাত খোঁজার ব্যাপারে কাজ করছি। সেগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি যাতে করে আমাদের সাথে যুক্ত সকল অংশীদারের জন্য সুষ্ঠু সরবরাহ চক্র নিশ্চিত করা যায়।"
অংশীদার যারা
লিলিটেইলরের অংশীদারদের মধ্যে রয়েছে- স্থানীয় দর্জি, ক্ষুদ্র কারিগর, ক্ষুদ্র ও মধ্যম শ্রেণীর মার্চেন্ট এবং ক্ষুদ্র ফ্যাশন উদ্যোক্তারা।
অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে কখনো কখনো তাদের সার্বিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। সেই সাথে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ব্যবসায়ে ক্ষতির অঙ্কটাও বেশ বড়।
শুধু তাই নয়, অংশীদারদের অনেকেরই প্রাতিষ্ঠানিক আয়ের উৎস নেই। ফলে, তাদের জন্য টিকে থাকা ও ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মিরপুর-১০ এর 'চয়নিকা টেইলর'-এর মালিক, জাহাঙ্গীর আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান লিলিটেইলরের সাথে কাজের অভিজ্ঞতার কথা।
"মহামারির সময় আমার ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। শুধুমাত্র লিলিটেইলরের কারণে আমি সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পেরেছি। আমার রেগুলার অর্ডারের পাশাপাশি বাড়তি অর্ডারও পেয়েছি এবং বাড়তি আয় হয়েছে", বলেন জাহাঙ্গীর।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
"স্টার্ট-আপ উদ্যোগের একদম প্রাথমিক পর্যায়ে থাকায়, আমরা স্থানীয় দর্জি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহায়তা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে আমাদের আরও নির্ভরযোগ্য কিছু সংস্থার সাথে অংশীদারত্বে যেতে হবে", বলেন সাইফ।
সাইফ আরও জানান, স্থানীয় দোকানগুলোকে জামানত-মুক্ত ঋণ অর্থায়ন করবে, এমন কোম্পানিগুলোর সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
তিনি বলেন, "আমরা কাপড়ের ব্যবসায় একটি বর্ধনশীল সামগ্রিক পরিবেশ তৈরি করতে চাই এবং আরও বেশি নারী উদ্যোক্তাকে যুক্ত করতে চাই।"
বাংলাদেশ ও কানাডায় আসা-যাওয়ার মধ্যে থেকেও লিলিটেইলরের তত্ত্বাবধান করা সাইফের জন্য সহজ নয়। কিন্তু নিজের কাজের মাধ্যমে জনসাধারণের মনে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতে চান এই তরুণ উদ্যোক্তা।