সাইকেল কীভাবে সোজা থাকে?
কম খরচ, পরিবেশবান্ধব ও একই সাথে শরীরের জন্য উপকারী বাহন হিসেবে বাইসাইকেল বিশেষভাবে পরিচিত। বাইসাইকেল নিয়েও মানুষের আগ্রহ বাড়ছে দিনের পর দিন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সংযুক্ত হতে পারছে রাইডাররা, তৈরি হচ্ছে সংগঠন। বিমল মুখার্জির মতো 'দুচাকায় দুনিয়া' ঘুরতে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে চ্যালেঞ্জ, রাইডারদের দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের চূড়া থেকে সমুদ্রসৈকতে।
কেবল অভিযাত্রী রাইডার কিংবা সাধারণ কাজে দৈনিক ব্যবহার করা মানুষেরাই নয়, গবেষকেরাও বাইসাইকেল নিয়ে আগ্রহী বহুকাল ধরেই। বাইসাইকেল কীভাবে সোজা থাকে, এই প্রশ্ন নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে গবেষকদের মধ্যে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিউ হান্ট সে প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন।
মৌলিক বিষয়
ছোট-বড় চাকা, শক্ত ফ্রেমের টায়ার, ব্রেক-গিয়ারবিহীন দুই চাকার বাহন, এই ছিল পেনি ফার্থিংয়ের মতো একেবারে প্রথমদিকের বাইসাইকেলের বৈশিষ্ট্য। বাতাসপূর্ণ টায়ার কিংবা সিটের নিচের স্প্রিং বাইসাইকেলকে আরও আরামদায়ক করে তুলেছে। মূলত বাইসাইকেলের প্রতিটি বস্তুই যোগ করা হয়েছে একে আরও আরামদায়ক, আরও গতিশীল, আরও নিরাপদ এবং আরও ভারসাম্যপূর্ণ করে তোলার জন্য।
গিয়ারের কথাই ধরা যাক। উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা পথ থেকে শুরু করে পাহাড় বেয়ে ওঠা-নামার জন্য, কিংবা বাইসাইকেলের গতি বাড়ানোর জন্য গিয়ার আবশ্যক, আর ভারসাম্য রক্ষার জন্য গতি হচ্ছে চালকের একান্ত বন্ধু। আবার ধরা যাক চাকার কথা। চাকার সরু সরু স্পোকগুলো শরীরের সম্পূর্ণ ওজন নেওয়ার মতো শক্ত নয়। কিন্তু চাকার রিম ও অ্যাক্সেল স্পোকগুলোকে এমনভাবে সহায়তা করে যে চাকাটি ভেঙে পড়ে না।
দ্বিধাবিভক্তি
গবেষকদের আগ্রহের অন্যতম বিষয় হলো কীভাবে বাইসাইকেলের অংশগুলো নিজেদের মধ্যে এবং একই সাথে বাইরের প্রভাবকগুলোর সাথে কাজ করে। বাইসাইকেল কীভাবে সামনে এগিয়ে যায়, তা নিয়ে সবাই একমত হলেও এটি কীভাবে সোজা থাকে তা নিয়ে এখনো গবেষকেরা দ্বিধাবিভক্ত।
অনেকের মতে, এর পেছনে রয়েছে জাইরোস্কোপিক প্রভাব। জাইরোস্কোপিক প্রভাবের ফলে কোনো গোলাকার বা চক্রাকার বস্তু নিজের অক্ষের ওপরেই ঘুরতে থাকে, যেমনটা হয় পৃথিবীর ক্ষেত্রে। পৃথিবী সর্বদা নিজের অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। আবার এই জাইরোস্কোপিক প্রভাবের কারণেই কোনো চক্রাকার বস্তু সোজা হয়ে ঘুরতে থাকে, যেমনটা দেখা যায় টেবিলের ওপর ঘুরতে থাকা কয়েনের ক্ষেত্রে। কিন্তু এই সোজা থাকার জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট গতি। জাইরোস্কোপিক প্রভাবের ফলে আরও একটা জিনিস লক্ষণীয়, এর ফলে আরেক ধরনের শক্তি উৎপন্ন হয়। বাইসাইকেলের গতি যত বাড়বে, এই শক্তিও তত বাড়বে।
কিন্তু কোনো সাধারণ সাইক্লিস্টের পক্ষে এই উৎপাদিত শক্তি টের পাওয়া সম্ভব নয়। যদি কোনো রেসার তার সাধারণ গতির চেয়ে ১০ গুণ গতিতে বাইসাইকেল চালাতে থাকে, তখন সে এই ফিরতি শক্তি টের পেতে পারে। ব্লেন্ডার কিংবা খুব হাই-পাওয়ার হেয়ার ড্রাইয়ার হাতে ধরলে এই জাইরোস্কোপিক ধাক্কা অনুভব করা যায়।
যদি জাইরোস্কোপিক প্রভাবের কারণেই বাইসাইকেল সোজা হয়ে যেত, তবে যে কেউই বাইসাইকেল চালাতে পারত, আলাদা করে বাইসাইকেল চালানো শিখতে হতো না। কিন্তু বাইসাইকেল চালানো শিখতে হয়, যেমনটা শিখতে হয় হাঁটা কিংবা সাঁতার কাটা। বাইসাইকেল চালাতে পারাও একটি দক্ষতা, আর এর পুরোটাই লুকিয়ে আছে সব সময় বাইসাইকেলকে নাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মধ্যে।
যখন বাইসাইকেল চালানো হয়, তখন সব সময়ই সামান্য হলেও ডানে বা বাঁয়ে যেতে হয়। যখন কেউ ডানে পড়ে যেতে থাকে, তখন অবচেতনভাবেই সে চাকা হালকা ডানে ঘুরিয়ে দেয় এবং বাইসাইকেলের চাকা সামনে এগিয়ে যায়। ফলে বাইসাইকেল নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং ব্যক্তি ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যায় না। একইভাবে, একজন সাধারণ মানুষ হাঁটার সময় যখন ভারসাম্য হারিয়ে একদিকে পড়ে যেতে থাকে, তখন সে অবচেতনভাবেই সেই দিকের পা মাটিতে রেখে ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে।
কেবল বাইসাইকেল চালাতে শেখা শুরু করা ব্যক্তির কাছে এই সব সময় নড়ে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারটি স্বাভাবিক মনে হতে পারে, কিন্তু একজন অভিজ্ঞ সাইক্লিস্টের কাছে ব্যাপারটি প্রায় অদৃশ্য। ব্যক্তিভেদে এর অভিজ্ঞতা যা-ই হোক না কেন, এই সব সময় যেকোনো একদিকে সরে গিয়ে বাইসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এবং ঠিক এ কারণেই একেবারে সোজা একটি লাইনের ওপর দিয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে যাওয়া খুব কঠিন। কারণ, ভারসাম্য রক্ষার জন্য কিছুটা ডানে বা বাঁয়ে সরতেই হবে।
সাইক্লিস্টদের ভাষায় 'ট্র্যাক স্ট্যান্ডিং' বলে একটি শব্দ আছে। মাঝেমধ্যে খেয়াল করলে দেখা যাবে, সাইক্লিস্টরা কোনো দিকে ভর না দিয়েই স্থির অবস্থায় পেডালের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বারবার সামনে ও পেছনে গিয়ে সাইক্লিস্টরা এভাবে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে।
চালকবিহীন বাইসাইকেল
কয়েক বছর আগে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেছেন বাইসাইকেলের জাইরোস্কোপিক প্রভাব সরিয়ে ফেলা যায় কি না, তা নিয়ে। পরীক্ষার জন্য এমন একটি বাইসাইকেল তৈরি করা হয়েছিল, যেটি সামনে যাওয়ার বদলে পেছন দিকে যাবে। বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, এটি চালানো হয়তো আরও কঠিন হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এটি স্বাভাবিক বাইসাইকেলের মতোই সহজভাবে চালানো যাচ্ছে।
আচ্ছা, যদি কোনো বাইসাইকেলে চালক না থাকে, তাহলে কেমন হয়? ধরা যাক, কোনো একটি ঢাল দিয়ে যথেষ্ট জোরে কোনো একটি বাইসাইকেল ছেড়ে দেওয়া হলো। যথেষ্ট গতি পেলে সাইকেলটি বেশ কিছুক্ষণ একা একাই সোজা থাকবে। তবে অনেকেই এর পেছনের কারণ হিসেবে সামনের চাকার জাইরোস্কোপিক প্রভাবকে উল্লেখ করেন। ২০১১ সালে অধ্যাপক অ্যান্ডি রাইনারের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী এমন একটি বাইসাইকেল তৈরি করেন, যেটি কোনো জাইরোস্কোপিক প্রভাব ছাড়াই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। কীভাবে এটি সম্ভব হলো? উত্তর: একজন স্বাভাবিক চালকের মতোই, একে সামনে এগিয়ে নিয়ে। পরীক্ষা সফলভাবে শেষ হলে অ্যান্ডি রাইনার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'বাইসাইকেলের সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, যদি এটি যথেষ্ট জোরে এবং খুব দ্রুত না চলে, তবে এটি নিজেই নিজের ভারসাম্য বজায় রেখে সামনে এগিয়ে যেতে পারে।'
ফলে একটি জিনিস নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে, যখন কেউ বাইসাইকেল চালানো শেখে, তখন এটি সম্পূর্ণ তার ভারসাম্য রক্ষার দক্ষতার ওপরেই নির্ভর করে, কোনো জাইরোস্কোপিক প্রভাবের ওপর নয়।