স্থায়ী শান্তি ও অগ্রগতিতে ধর্মীয় সম্প্রীতির কোনো বিকল্প নেই
কুমিল্লার ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রণিধানযোগ্য। ভারত এবার খুব সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। স্মরণকালের মধ্যে এমনটি দেখা যায়নি। আমাদের দেশের প্রতিটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় প্রতিবেশী দেশ ভারত উদ্বেগ জানায়। ভারতীয় হাইকমিশন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। সান্ত্বনা দেয়। পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। পরিদর্শন শেষে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও জানায়। কূটনীতিক সীমাটাও মাথায় রাখতে হয়। এবারের কুমিল্লার ঘটনার পর ভারতীয় রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভারতের পার্লামেন্টে পাস হয়েছিল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ- যাতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে আসা হিন্দু-শিখ-খ্রিস্টান-বৌদ্ধদের সে দেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়। এই আইনের বিরোধিতা করে সর্বভারতীয় তীব্র আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। বাংলাদেশের ঘটনায় বিজেপির পালে নতুন হাওয়া লেগেছে। বিজেপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সিএএ বাস্তবায়নের জন্য কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানাচ্ছে।
'৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্রে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ৩০ শতাংশের বেশি মানুষ এই পাকিস্তান অংশেই থেকে গিয়েছিলেন। এটিই তাদের জন্মভূমি ও আবাসস্থল। মানুষ পুরাতন সাম্প্রদায়িকতার ক্ষত মুছে ফেলতে চায়। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বিপরীতে একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখতে থাকে। '৪৭ থেকে '৭১, ২৪ বছরের লম্বা পথ। ইতিহাসের অনেকগুলো বাঁক। '৭২ সালের ৪ নভেম্বর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়। মানুষের লালিত স্বপ্নের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মানুষ নতুন করে আশায় বুক বাঁধতে শুরু করে। ইতিহাস কখনো সরলরেখায় চলে না। সে কারণে হোঁচট খেতে সময় লাগেনি। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রচেতনার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষার মূলে কুঠারাঘাত আসলে কোনটি! সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংযুক্ত করা নাকি সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করা, কোনটা? আমাদের সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্যের চূড়ান্ত সর্বনাশকারী সংবিধানের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীকে আড়াল করবার জন্য কেউ কেউ ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু এই সম্মেলনে অংশ নেবার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিলেন, যা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং কূটনৈতিক সাফল্যের নজির।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর ধরনে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। এটা এখন এক বিশ্বময় সংকট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের সুযোগে 'ফেক নিউজ' ছড়িয়ে পড়ছে। গত দুই দশকের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, যতগুলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার সূচনা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের 'ফেক নিউজের' ভিত্তিতে। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তম বড়ুয়া নামের এক ব্যক্তি কোরআন ও নবীকে ফেসবুকে 'অবমাননা' করেছে এই খবরের ভিত্তিতে ১৯টি বৌদ্ধ মন্দির জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অথচ এই নামের কোন ব্যক্তির অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায়নি। ২০১৬ সালে নাসিরনগরের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তি রসরাজের ফেসবুক দূরের কথা, সাধারণ অক্ষরজ্ঞানও ছিল না। ২০১৭ সালে রংপুরের গঙ্গাচরায় মানসিক ভারসাম্যহীন একটি মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়। এই সময়ের আলোচিত শাল্লা উপজেলার নোয়াগাও গ্রামের ঝুমন দাস দীর্ঘ কারাভোগ করে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। কেবলমাত্র গুজবের উপর ভিত্তি করে একের পর এক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি ঘটনা সরকার শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করলেও আক্রান্ত মানুষ খুব সহজে আস্থায় ফিরতে পারছে না। নিরাপত্তার অভাববোধ দূর হতে সময় লাগে। প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হতে হবে। অভিযোগ করা হয়, আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচার হয় না-এই অভিযোগের সত্যতা থাকলে আক্রান্ত মানুষের নিরাপত্তাহীনতার বোধ কখনোই দূর হবে না। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা সাধারণ কোন ফৌজদারি অপরাধ নয়, এটার তদন্ত ও বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা গেলে মানুষের আস্থা ফিরে আসবে এবং টিকে থাকার সংগ্রাম দৃঢ়তা পাবে।
ভারতের ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা রাজনৈতিক মাঠ ও সোশ্যাল মিডিয়া গরম করে ফেললেও ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তর বেশ সাবধানী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় খুব দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করেছে এবং সরকার ও সুশীল সমাজের সহযোগিতায় দুর্গাপূজা সম্পন্ন হতে পেরেছে।
কুমিল্লার ঘটনার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে, অপরাধী যেই হোক, তাকে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার কথা জানিয়েছেন। সহিংসতা শক্ত হাতে দমন এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দেবার অঙ্গীকার করেন তিনি। তিনি একই সাথে বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতকেও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, "সেখানেও (ভারতে) এমন কিছু যেন না করা হয় যার প্রভাব আমাদের দেশে এসে পড়ে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বানে ভারত যথাযথ সাড়া দিয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনাগুলোর বিষয়ে মন্তব্য করতে যেয়ে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের সাবেক কূটনীতিক আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানকে দায়ী করেছেন। আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর এই অঞ্চলে ইসলামিক উগ্রবাদীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সে কারণে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। আমরা সর্বক্ষেত্রে গঠনমূলক আচরণ আশা করবো। সমগ্র ভারতজুড়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নামাবলী ছুঁড়ে ফেলে হিন্দুত্ববাদের যে উল্লম্ফন এবং মুসলিম নিগ্রহের যত ঘটনা তার প্রভাব পাশের দেশ বাংলাদেশে পড়ে, বিচলিত করে। এদেশের মানুষ প্রতিক্রিয়া জানায়। দূতাবাস অভিমুখে বিক্ষোভ জানায়। এটাই গণতান্ত্রিক রীতি। ধর্ম দিয়ে সমাজকে বিভাজিত করার সকল তৎপরতা বন্ধের জন্য ভারত ও বাংলাদেশকে নিজস্ব রাজনৈতিক সংস্কার ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা সমুন্নত রাখার উপায়গুলো নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে যৌথ কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্বায়নের এই যুগে কেউ এককভাবে কোন সমস্যার সমাধান করতে পারে না। দরকার যৌথ প্রয়াস। এই অঞ্চলের স্থায়ী শান্তি ও অগ্রগতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনার বাস্তবায়ন ও ধর্মীয় সম্প্রীতির কোন বিকল্প নেই।