সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় যেভাবে পথ দেখাল লক্ষ্মীপুর
কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কথিত 'কোরআন অবমাননা'র ঘটনায় নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফেনী ও চট্টগ্রামে পূজা মণ্ডপ ও হিন্দুদের ঘরবাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটলেও এর আঁচ লাগেনি একই অঞ্চলের জেলা লক্ষ্মীপুরে। মেঘনার কোল ঘেঁষা দক্ষিণের এই জেলার বাসিন্দারা বলছেন, হিন্দু-মুসলিম বন্ধন আর পুলিশ-প্রশাসনের জোরালো ভূমিকা থাকায় এ জেলায় বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি ঘটনা ঘটলেও কোনো সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেনি।
ভৌগলিকভাবে লক্ষ্মীপুরের উত্তর আর পশ্চিমের সীমানায় চাঁদপুর আর দক্ষিণ-পূর্বের সীমানায় নোয়াখালীর অবস্থান। আর ফেনী ও কুমিল্লাও ১০০ কিলোমিটারের মধ্যেই। গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার ঘটনায় জেলাটির শহর এলাকায় বেশ কয়েকটি মণ্ডপ ভেঙ্গে দেয় একদল হামলাকারী। এর প্রভাবে একইদিন চাঁদপুরে মিছিল থেকে মন্দিরে হামলা চালালে সেখানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন চারজন। ১৫ অক্টোবর দুর্গাপূজার দশমীর দিন নোয়াখালীর চৌমুহনীতে বেশ কয়েকটি পূজা মণ্ডপ ও হিন্দুদের দোকানপাটে হামলা চালানো হয়। ওই ঘটনায় নিহত হন তিন ব্যক্তি। একই সময়ের ব্যবধানে ফেনী ও চট্টগ্রামেও হিন্দুদের মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে।
লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া হামলার প্রেক্ষিতে অনেকটা আতঙ্কে থাকলেও নিরাপদে-নির্বিঘ্নেই পূজা উদযাপন করেছেন এ জেলার হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। রামগতির একটি মন্দিরে কিছু মানুষ জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশি তৎপরতায় তা পণ্ড হয়ে যায়।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার সভাপতি শংকর মজুমদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বলতে গেলে লক্ষ্মীপুরে এর তেমন প্রভাব পড়েনি। ২টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বরং লক্ষ্মীপুরের ৭৮টি মণ্ডপে পূজা উদযাপন করা হয়েছে স্বাভাবিকভাবে। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দুদেরকে পূজা উদযাপনে নজিরবিহীন সহযোগিতাও করেছে।"
লক্ষ্মীপুর শহরের হাসপাতাল সড়কের দু'ধারে পুরোটাই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাস। অষ্টমীর দিন জেলার রামগতিতে রাতের দিকে বুড়া কুর্তার আশ্রমের সাথের চর সীতা মন্দিরে কিছু মুসল্লি জড়ো হবার চেষ্টা করেন, মন্দিরের বাইরের সড়কের একটি মোটরসাইকেলে আগুন দেন তারা। তবে এমন পরিস্থিতিতে সাথে সাথে লক্ষ্মীপুর শহরের কালী মন্দিরে যান পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসক। প্রায় আড়াই ঘণ্টা সভা করেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে। ওই মন্দির এলাকা ও আশপাশের এলাকায় এক প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। রাত থেকেই পুলিশ পাহারা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় একজন অপু চন্দ্র দাস। মন্দিরে নবমীতেও একই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা দেয় হয়। অনেক পুলিশ মোতায়েন থাকার কারণে বিক্ষুব্ধ মুসল্লিরা সঘটিত হবার চেষ্টা করলেও তা ভেস্তে যায় বলে জানান অপু চন্দ্র দাস।
তিনি বলেন, "মূলতে সকলে মিলেই তাদের প্রতিহত করা হয়।"
দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের আগে শহরের একটি মন্দিরের ব্যানার ছেঁড়ার চেষ্টা করা হলে পুলিশ সাথে সাথে তাদের নিবৃত করে সরিয়ে দেয়। এখনো পুরো শহরে নিয়মিত পুলিশ টহল দিচ্ছে, নামাজের আগে-পরে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেও যাতে তা নাহয় সেদিকেও নজর দেয়া হচ্ছে। এছাড়া মন্দিরগুলোতে পূজার সময় ড্রোন দিয়ে লোকজনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে বলেও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
অংকন সাহা নামে একজন আইনজীবী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এটুকু বলতে পারি অনেক জেলার তুলনায় লক্ষ্মীপুরে তুলনামূলক ভালো পূজা উদযাপন হয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে, দুই সম্প্রদায়ের ইচ্ছা, তরুণদের এগিয়ে আসা ও প্রশাসনের শুরু থেকেই গুরুত্ব দেয়ার কারণে।"
তিনি বলেন, "যদিও মনের ভেতরে ভয় ছিল, আনন্দময়ী কালী মন্দিরে সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ বিসর্জন নিয়ে, তবে আমাদের তারও কয়েক ঘণ্টা আগেই করতে হয়েছে।"
স্থানীয় হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বললে তারা এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রীতি ধরে রাখতে পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করেন। তবে এটা শুধুই পেশাদারি মনোভাব আর সব সম্প্রদায়ের মানুষের সহযোগিতায় সম্ভব হয়েছে বলে জানান জেলার পুলিশ সুপার।
পূজা উদযাপন পরিষদের শংকর মজুমদার জানান, এমন প্রশংসনীয় কাজের জন্য লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে শহরের শ্যামসুন্দর জিউর আখড়া মন্দিরে ডেকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক স্বপন দেবনাথ জানান, কুমিল্লার ঘটনার পরপরই লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। মণ্ডপ পাহারা দিতে ও এর আশপাশের পরিবেশ স্থিতিশীল রাখতে পুলিশ টানা ৭২ ঘন্টা সময় কাজ করেছে।
তিনি বলেন, "লক্ষ্মীপুর জেলা শহরে বেশ কয়েকটি মন্দির, ২টি বড় পূজা মণ্ডপ এবং একটি অভিজাত হিন্দু এলাকা রয়েছে, এর কোনটিতেই সামান্যতম সমস্যা হয়নি। শুধু লক্ষ্মীপুর জেলা শহরই না, জেলার পাঁচ উপজেলা শহরেই বহু মন্দির এবং পূজা মণ্ডপে নির্বিঘ্নে পূজা হয়েছে।"
এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে লক্ষ্মীপুরের এমন ঘটনাকে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির হিসেবে দেখছেন।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ রামগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি সমীর রঞ্জন সাহা জানান, উপজেলার প্রত্যন্ত ইছাপুর ইউনিয়নে ৫টি পারিবারিক মন্দিরে দুর্বৃত্তদের হামলার ঘটনার পরপরই পুলিশ ও প্রশাসন তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়। এলাকাবাসী মন্দিরগুলো পাহারায় নেমে পড়ে। পুলিশ হামলাকারী অজ্ঞাত ৪০/৫০ জন দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পরে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায় নির্বিঘ্নে পূজা উদযাপনে ব্যাপক সহযোগিতা করে যা ছিল বিগত বছরগুলোর মধ্যে নজিরবিহীন।
লক্ষ্মীপুরের রামগতির চরসীতা মন্দিরের সামনে একটি গণপরিবহনে আগুনের ঘটনায় করা মামলায় পুলিশ বলছে, ১৩ অক্টোবর রাতে রামগতি উপজেলার জমিদারহাট বাজারে রাম ঠাকুরাঙ্গন মন্দিরে ও পূজা মন্ডপের সামনে থাকা একটি মটরসাইকেল ও পাশের একটি রান্নাঘরের লাড়কিতে আগুন ধরিয়ে দেয় একদল মুখোশধারী দুর্বৃত্ত। এসময় তাদের সঙ্গে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় পুলিশ অজ্ঞাতনামা ২৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
লক্ষ্মীপুরের রামগতি সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রাইসুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, রামগতির ওই ঘটনাটির পরপরই দায়িত্বরত পুলিশ আরো তৎপর হয়ে স্থানীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়, মসজিদের ইমাম, মাদরাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের সঙ্গে সম্প্রীতি সমাবেশ করে। একইসঙ্গে জেলার ৭৪টি বিট পুলিশিংয়ের উদ্যোগে সম্প্রীতি সমাবেশ হয়। পরে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় প্রতিটি পূজা মণ্ডপে নির্বিঘ্নে পূজা উদযাপিত হয় এবং প্রতিমা বিসর্জন করে হিন্দু সম্প্রদায়।
তিনি আরও জানান, রামগতি ও রামগঞ্জের ঘটনার পরপরই লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসাইন আকন্দ, পুলিশ সুপার ড. এইচএম কামরুজ্জামানসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের রায়পুর উপজেলার সাধারণ সম্পাদক শংকর মজুমদার বলেন, "১৯৪৬ সালে ইতিহাস কুখ্যাত যে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষ মারা যায় তার সূত্রপাত হয় বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থেকে। সে ঘটনার সূত্র ধরে মহাত্মা গান্ধী বৃহত্তর নোয়াখালী সফর করেন। কিন্ত ইতিহাসখ্যাত সেই দাঙ্গা এলাকার মানুষ এবার যে সম্প্রীতির পরিচয় দিয়েছে তা নজিরবিহীন।"
সার্বিক বিষয়ে লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার ড. এএইচএম কামরুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, কুমিল্লার ঘটনার আগ থেকেই তারা সতর্ক ছিলেন। মসজিদ-মাদ্রাসা ও মন্দির কমিটির লোকজনের সঙ্গে ঘটনার আগে পরে এসপি অফিসে দফায় দফায় বৈঠক করেন। এমনকি থানাগুলোতে নিয়মিত তাদের নিয়ে ওসিরা বসেছেন। সেখানে মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারাও ছিলেন।
তিনি বলেন, "মন্দিরকেন্দ্রিক, পুলিশের সাথে আনসারও বাড়ানো হয়েছে। স্থানীয়দেরও ইনভলব করেছি। সকলের সহযোগিতা নিয়েই এমন সুন্দর আয়োজন সম্ভব হয়েছে। এতে করে সম্প্রীতি ধরে রাখা গেছে। মসজিদের পাশের মন্দিরগুলোতে বাড়তি নজর দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, নামাজের সময় যেন ঢাকের বাদ্য বা অনেক বেশি শব্দ না করা হয়।"
"এখনো আমরা গোয়েন্দা নজরদারি অব্যহত রেখেছি, তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বলেছেন, তারা স্বস্তিতে আছেন, শঙ্কা নেই। এখন একটা স্বাভাবিকভাবেই জীবনযাপন করছেন।"
২০১১ সালের আদমশুমারী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৮ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস রয়েছে লক্ষ্মীপুরে। যার মধ্যে রামগতি উপজেলার রঘুনাথপুর, চর ডাক্তার, চরসীতা, কমলনগর উপজেলার চর জাঙ্গালিয়া, করুনানগর, রায়পুর উপজেলার ক্যাম্পেরহাট, চর বংশী, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের শাখারি পাড়া, জোড়াদিঘীপাড়, চন্দ্রগঞ্জ, রামগঞ্জ উপজেলার করপাড়া, ইছাপুর এবং রামগঞ্জ শহরে অধিকাংশ হিন্দু পরিবারের বসবাস।
চলতি বছরে জেলায় ৭৮টি পূজা মণ্ডপে দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। যার মধ্যে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ৩২টি, রামগঞ্জে ১৯টি, রায়পুরে ১২টি, কমলনগরে ৩টি এবং রামগতিতে ১২টি পূজা মণ্ডপ ছিল।