আগাম গোয়েন্দা তথ্য থাকলেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঠেকানো যাচ্ছে না নৃশংসতা
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘটিত অধিকাংশ ঘটনার আগাম গোয়েন্দা তথ্য পেয়ে নিরাপত্তা জোরদারের পরও নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলো ঠেকানো যাচ্ছে না।
ক্যাম্পে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, গত শুক্রবার ভোরে ক্যাম্পের একটি মাদ্রাসায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে ঘুমন্ত ছাত্র-শিক্ষকসহ ৬ জনকে হত্যার যে ঘটনা ঘটেছে তার আগেই ক্যাম্পের অলি-গলিতে রেইড দেয় পুলিশ। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহলদল মাদ্রাসার সামনে থেকে সরে অন্যদিকে গেলে ঘাপটি মেরে থাকা দুর্বৃত্তরা মাদ্রাসায় হামলা চালায়। গত ২৯ সেপ্টেম্বর যখন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছিলো, তখনো এরকম ঘটনাই ঘটেছে।
নাশকতার আগাম তথ্যের বিষয়টি স্বীকার করলেও আলোচিত এসব হত্যাকাণ্ডকে 'অনাকাঙ্খিত অঘটন' হিসেবেই দেখছেন ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
তবে, আগাম তথ্য থাকার পরও নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকলে তা 'সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতার ফল' বলেই মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম।
গত শুক্রবার (২২ অক্টোবর) ভোর সোয়া ৪টার দিকে উখিয়ার এফডিএমএন ক্যাম্প-১৮ এইচ-৫২ ব্লকের 'দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ' মাদ্রাসায় একদল মুখোশধারী দুর্বৃত্ত অকস্মাৎ এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে নিহত হন ওই মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ মো. ইদ্রীস (৩২), ইব্রাহীম হোসেন (২৪), শিক্ষার্থী আজিজুল হক (২২), মো. আমীন (৩২) মাদ্রাসার শিক্ষক নুর আলম ওরফে হালিম (৪৫) ও শিক্ষক হামিদুল্লাহ (৫৫)। গুলির পর মৃত্যু নিশ্চিত করতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে চালানো হয় পাশবিকতা। আর ২৯ সেপ্টেম্বর নিজ অফিসে ডেকে এনে গুলি করে হত্যা করা হয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে।
নাম না প্রকাশের শর্তে ক্যাম্পে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থার ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ক্যাম্পে পাশবিকতা চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে এমন তথ্য পেয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করা হয়। সেকারণে পুরো ক্যাম্প জুড়ে অলিগলিতে জোরদার করা হয়েছিল কঠোর নিরাপত্তা। পুলিশের একাধিক টিম পৃথকভাবে টহল দেয়।
"যে মাদ্রাসায় ন্যাক্কারজনক পাশবিকতা চালানো হয়েছে সেখানেও একদল পুলিশ রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত টহলরত ছিলো। সেখানকার টিমটি অন্য এলাকায় টহল দিতে গিয়ে আবার পূর্বের জায়গায় ফিরে আসার আগেই দুর্বৃত্তদল এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে এ নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটায়।"
তার ভাষ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর সন্ত্রাসী সংগঠন কথিত আরসার নাম ভাঙ্গিয়ে অপকর্ম করা দুর্বৃত্তদের কঠোরভাবে দমনে কাজ করছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যে মাদ্রাসায় হামলা চালানো হয় সেই মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অন্য সংশ্লিষ্টরা ওই দুর্বৃত্তদের কার্যক্রমের বিরোধী ছিলেন। নিহত শিক্ষক ইদ্রিস কথিত আরসার নাম ভাঙ্গিয়ে চলা দুর্বৃত্তদের প্রতিহত করতে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। এমন কয়েকটি প্রচারণার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও রোহিঙ্গাদের দারা পরিচালিত কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গ্রুপে ভেসে বেড়াচ্ছে। এটি দেখেই নিজেদের অস্থিত্ব সংকট কাটাতে পাশবিক কর্মকাণ্ড বেছে নেয় অপরাধীরা।
ক্যাম্পে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থার আরেকটি সূত্র দাবি করেছে, মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের আগেও একইভাবে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। তাকে বিদেশী বিভিন্ন নাম্বার থেকেও হুমকি দেয়ার বিষয় বার বার সামনে আসে। এরপর প্রায় প্রতিনিয়ত মুহিবুল্লাহ ও তার পরিবারের নিরাপত্তায় পুলিশ পাহারা থাকতো। ঘটনার দিনও নামাজ শেষে শেডে (বাসায়) ফেরা পর্যন্ত পুলিশের একটি টহলদল মুহিবুল্লাহর বাড়ির আশাপাশে ছিলো। তিনি বাসায় ঢুকে গেছেন দেখে টহলদল সেখান থেকে অন্যস্থানে টহলে চলে যায়। এই সময়টাকে বেছে নিয়ে তাকে হত্যার পর সরে পড়ে দুর্বৃত্তরা।
এ বিষয়ে ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন-৮) উপ-অধিনায়ক কামরান হোসাইন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ক্যাম্পের কয়েকটি এলাকায় মারামারি হতে পারে এমন তথ্য ছিলো আমাদের কাছে। যেসব এলাকার কথা বলা হয়েছিলো সেখানে ওই মাদ্রাসা এলাকাটিও ছিলো। ঝুঁকির কথা চিন্তা করে ওই মাদ্রাসার আশপাশ এলাকায় আমারা রাতেই ব্লকরেইড পরিচালনা করি। রাত ৩টা পর্যন্ত কঠোর অবস্থান ছিলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।"
"সেখানে থাকা টিমটি সোয়া তিনটার দিকে ক্যাম্প-১১ তে ব্লকরেইডে গেলে ওই মাদ্রাসায় হামলার ঘটনা চলছে বলে খবর আসে। সঙ্গে সঙ্গে এপিবিএন-এর একটি টিম ওই এলাকায় গিয়ে ঘেরাও করে। কিন্তু দুর্বৃত্তরা তার আগেই সটকে পড়ে। তবে, ঘটনায় অংশ নেয়া মুজিবুর রহমান নামে একজনকে সশস্ত্রাবস্থায় আটক করে আমাদের টিম।"
সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরও কেন টহল টিমকে অন্যজায়গায় পাঠানো হলো সেই প্রশ্নের জবাবে উপ-অধিনায়ক কামরান বলেন, "একটা জায়গায়তো সর্বক্ষণ ব্লকরেইড করার সুযোগ নেই। ক্যাম্পের এরিয়া বড় হওয়ায় অন্য এলাকার নিরাপত্তাও দেখতে হয়। এ কারণে সেখানে থাকা টিমটি শিডিউল মতো ক্যাম্প-১১ তে গিয়েছিলো। আর এ সুযোগটাই বেছে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এমনও হতে পারে, মাদ্রাসায় অবস্থানকারীদের মাঝেও দুর্বৃত্তদলের কেউ লুকিয়ে ছিলো।"
দুর্গম ক্যাম্প এলাকায় সঠিকভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বর্তমান কর্মরত সদস্য সংখ্যা আরো কয়েকগুণ বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন এপিবিএন এর এ কর্মকর্তা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আগাম গোয়েন্দা তথ্য থাকার পরও যদি এসব নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকে, তবে তা বেদনাদায়ক ও উৎকন্ঠার। তাহলে মনে করতে হবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। ভবিষ্যত নিরাপত্তা জোরদারে এটি কাটিয়ে উঠা দরকার। তা সম্ভব না হলে সামনের দিনে আরো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে।"
১৪ এপিবিএন এর অধিনায়ক নাইমুল হক বলেন, "মুহিবুল্লাহ হুমকি ও নিরাপত্তাহীনতার কথা কখনো আমাদের জানাননি। এরপরও প্রত্যাবাসনপ্রেমী ও রোহিঙ্গা নেতা হিসেবে স্বপ্রণোদিতভাবে প্রায় প্রতিনিয়ত মুহিবুল্লাহ ও তার পরিবারের নিরাপত্তায় পুলিশ পাহারা থাকতো। ঘটনার দিনও নামাজ শেষে শেডে (বাসায়) ফেরা পর্যন্ত পুলিশের একটি টহল দল মুহিবুল্লাহর বাড়ির আশাপাশে ছিলো। তিনি বাসায় ঢুকে গেছেন দেখে টহলদল সেখান থেকে অন্যস্থানে টহলে চলে যায়। এই সময়টাকে বেছে নিয়ে অঘটন ঘটিয়ে তাকে হত্যার পর সটকে পড়ে দুর্বৃত্তরা।"