আগামী বছর যে ১০টি বিষয় খেয়াল করতেই হবে আপনাকে
২০১৯ সালে শুরু হওয়া করোনা মহামারি ২০২১ সালের সঙ্গে শেষ হবে বলে আশা করছে পুরো বিশ্ব। সেই হিসেবে তাই ২০২২ সাল হতে চলেছে পুরো বিশ্বের জন্য একটি 'টার্নিং পয়েন্ট'। অদ্ভুত এক অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে কেটেছে মহামারির প্রায় দুই বছর। সেই অনিশ্চয়তার সঙ্গে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে নিতে শিখছে মানুষ। মহামারির কারণে বদলে গেছে বিশ্ব রাজনীতির ধরণ, অর্থনীতি, কর্মক্ষেত্র, ভ্রমণ ও পর্যটনের মতো আরও অনেক বিষয়। সেইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আরও গুরুতরভাবে।
২০২২ সাল যতটা ঘনিয়ে আসছে, নতুন বছরের নতুন সব সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়েও জনমনে দেখা দিচ্ছে ততটাই অধীরতা। ব্রিটিশ ম্যাগাজিন 'দ্য ইকোনোমিস্ট'ও তাই প্রকাশ করেছে ১০টি বিষয়ের এমন একটি তালিকা, যা নজর কাড়তে পারে বিশ্ববাসীর।
চলুন জেনে নেওয়া যাক কী কী বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে টম স্ট্যান্ডেজের তৈরি করা সেই তালিকায়-
টিকা নিয়ে লড়াই
করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের পর বিজয়ের হাসি খুব বেশি দিন টিকে থাকেনি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মুখে। টিকার মাধ্যমে মহামারিকে জয় করার যে স্বপ্ন সবাই দেখেছিল, তা উন্নত বিশ্বের টিকা মজুদ করে রাখার প্রবণতায় এখন প্রায় স্লানের পথে। তবে, টিকা কূটনীতি আগের চেয়ে কিছুটা স্থিতিশীল পর্যায়ে আসলেও সামনের দিনগুলোতে এ নিয়ে দেশগুলোর মাঝে বিবাদ চলার সম্ভাবনা রয়েছে।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার
মহামারির কবল থেকে অর্থনীতিকে ফিরিয়ে আনা বেশ জটিল হবে। কারণ বিগত প্রায় দুই বছরে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছে; বন্ধ হয়ে গেছে কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিকারী বহু প্রতিষ্ঠান। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ। কিন্তু সেইসঙ্গে বাড়েনি মানুষের আয়, বরং বেশির ক্ষেত্রেই কমেছে। অর্থনীতিবিদদের ভবিষ্যদ্বাণী, অর্থনীতির এমন অস্থিতিশীল অবস্থা শক্তিশালী ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে আয়ের ব্যবধান আরও বাড়াবে; এবং এর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে লাগতে পারে দীর্ঘ সময়।
বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন ধারা
এ বছরের শুরুতে হোয়াইট হাউসের দায়িত্বে এসেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্তরসূরি জো বাইডেন। রিপাবলিকান থেকে ডেমোক্র্যাটের হাতে ক্ষমতার পালাবদলে তাই বিশ্ব রাজনীতিতেও লেগেছে কিছুটা পরিবর্তনের ছোঁয়া; আর সেই সঙ্গে করোনা ভীতি তো আছেই। ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি, স্বাস্থ্যখাত ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই পরিবর্তন এনেছেন বাইডেন। সেইসঙ্গে চির প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গেও হয়েছে কয়েক দফা আলোচনা। ধারণা করা হচ্ছে, পরিবর্তনের এই ধারা সামনের দিনগুলোতেও বজায় থাকবে।
চীন-মার্কিন উত্তেজনা
চীনের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ স্থিতিশীল পর্যায়ে থাকলেও, বিভিন্ন ইস্যুতে দুই দেশের বৈরিতা থেমে নেই। শি জিনপিংয়ের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের বিপরীতে এশিয়া প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের 'কোয়াড' জোট গঠনের উদ্যাগ চীনকে যথেষ্ট উত্তেজিত করেছে। এছাড়া, তাইওয়ান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও চীনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুতে পশ্চিমাদের অবস্থান, দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা সামনে আরও বাড়াতে পারে।
প্রযুক্তির ব্যবহার
করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে লকডাউনে ঘরের ভিতরে বসে মানুষ যে অনলাইন দুনিয়ার ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ভিডিও-কনফারেন্সিং ও অনলাইন শপিং থেকে শুরু করে দূরবর্তী অনেক কাজই সম্ভব হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা কার্যক্রম পর্যন্ত চলেছে প্রযুক্তির মাধ্যমে। ২০২২ সালে করোনার প্রভাব আরও কমে আসলেও, প্রযুক্তির প্রভাব কতোটা কমবে সেটা তো সময়ই বলে দেবে।
পর্যটন খাত
মহামারির সরাসরি প্রভাব পড়েছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ওপর। সংকুচিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ শিল্প। এয়ারলাইন্স, হোটেল চেইন ও বিমান কর্তৃপক্ষ ক্ষতির শিকার হবেন এই পরিবর্তনে। বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক বিনিময়ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এর প্রভাবে।
জলবায়ু সংকট
করোনার সঙ্গে বেড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। ভূমিধস, দাবানল, তাপদাহ ও বন্যার মতো জলবায়ু সংকট বাড়লেও, তা মোকাবেলার করতে নেওয়া হচ্ছে না তেমন কার্যকর পদক্ষেপ। এদিকে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর দিকে বড় অঙ্কের তহবিলের আশায় তাকিয়ে আছে জলবায়ুতে পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতির সম্মুখীন দেশগুলো। পৃথিবীতে মহামারি আসার আগে থেকেই জলবায়ু সংকট নিয়ে অনেক রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উন্নত দেশগুলো। তবে খুব কমই বাস্তবায়িত হতে দেখা গেছে সেসব প্রতিশ্রুতি। যদি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও গভীর হয়, সেক্ষেত্রে দুই দেশ তাদের কার্বন নির্গমন ও তহবিল প্রদানের প্রতিশ্রুতি কতোটা রক্ষা করবে সে এক বড় প্রশ্ন।
কাজের সুযোগ
মাহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে পরিবর্তন এসেছে কর্মক্ষেত্রে। আর এই পরিবর্তন যে দিন দিন আরও ব্যাপক হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাড়িতে বসে অনলাইনে কাজ করা এখন স্বাভাবিক। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, অফিসে ফেরার ক্ষেত্রে নারীদের অনীহা বেশি। তাই তাদের পদোন্নতির বিষয়টি পড়তে পারে ঝুঁকিতে। ট্যাক্সবিধি ও প্রবাসী কর্মীদের নিয়েও চলছে নানা ধরনের পর্যবেক্ষণ ও বিতর্ক। এছাড়া, স্বাস্থ্যখাতে বেড়েছে কাজের সুযোগ।
মহাকাশ অভিযান
মহামারির মাঝেও থেমে নেই নতুনদের মহাকাশ অভিযান। ভ্রমণ পিপাসুরা এখন শুধু মাটিতেই নয়, বরং পকেটের টাকা খরচ করে ভ্রমণে যাচ্ছেন মহাকাশে। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে সরকারি লোকের চেয়ে বেশি অপেশাদার শখের নভোচারীরা যাবেন মহাকাশ ভ্রমণে। ইতোমধ্যে, চীন তাদের মহাকাশ স্টেশন তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। চলচ্চিত্র নির্মাতারাও মহাকাশে শুটিং করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। মহাকাশ পর্যটন নিয়ে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে ব্যাবসায়ীক মডেল। সামনের বছরে শক্তিশালী অর্থনীতিগুলোর মধ্যে মহাকাশ পর্যটন ব্যবসায় নিয়ে যে প্রতিযোগিতা চলবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
অবশেষে, পৃথিবীতে মহামারি আসার আগে থেকে শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষকরা আরও যেসব সমস্যা নিয়ে উদ্বেগ দেখিয়েছেন, করোনা যেন সেগুলো আমাদের একেবারে ভুলিয়ে দিয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ও পারমাণবিক সন্ত্রাসবাদের মতো গুরুতর বিষয়গুলো এখন অবহেলিত। নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে মহামারির পাশাপাশি আগের সমস্যাগুলোকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে নীতি নির্ধারণের সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসা।
সূত্র: দ্য ইকোনোমিস্ট