বাংলাদেশের ওপর এসে পড়া বিমান ও এক অস্ট্রেলিয়ান টেস্ট ক্রিকেটার
ছয় বছর চলেছিল সে যুদ্ধ। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। একদিকে ছিল জার্মানি, ইতালি, জাপান যাদের বলা হচ্ছে অক্ষশক্তি। তাদের বাধা দিতে মিত্রশক্তি নামে জোট বেঁধেছিল সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্সসহ আরো কিছু দেশ। ভারতবর্ষে তখন ছিল ব্রিটিশরাজ। সে হিসাবে ভারতও শিকার হয়েছিল জাপানী হামলার। এভাবে বলা যায় সারা বিশ্বই জড়িয়ে পড়েছিল সে ভয়াবহ যুদ্ধে। নাম তার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
মহাযুদ্ধের আঁচ লেগেছিল বাংলাদেশের গায়েও। তখন ব্রিটিশ আর আমেরিকার অনেক সৈন্য বাংলাদেশের রাস্তায় দেখা গেছে। কিছু বাংকার টেকনাফে আজও দেখা যায়। চট্টগ্রাম আর কুমিল্লায় যে দুটি যুদ্ধ-গোরস্তান আমরা দেখতে পাই তার পুরো নাম আসলে কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্রি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণদানকারী যোদ্ধাদের কবর আছে ওগুলোয়। তাই বোঝাই যাচ্ছে, আক্রমণ যেমন হয়েছিল, তেমনি হয়েছিল পাল্টা আক্রমণও। আর তার বেশিরভাগটাই কিন্তু আকাশপথে। বাংলাদেশের এখানে-সেখানে যেসব বিমান ভূপাতিত হয় তখন, তার কয়েকটির খোঁজ পাওয়া গেছে।
২০২০ সাল। রেজাউল করিম একজন কৃষক। বাড়ি লালমনিরহাট। তার আবাদি জমির উঁচু অংশ সমান করতে কয়েকজন মজুর নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিছু মাটি সরানোর পরই লোহার একটা বড় খণ্ড তাদের নজর কাড়ে। বিষয়টি পাঁচকান হতে দেরি হয়নি। পুলিশ এলে সেটিকে বিমানের অংশ বলে ধারণা করে। পুলিশ ঘটনাটি জানায় জেলা প্রশাসককে। এরপর বিমান বাহিনীর সদস্যরা মাটির নিচ থেকে একটি ফুয়েল বার্নিং এগজস্ট, দুটি ল্যান্ডিং গিয়ার, একটি প্রপেলার ইঞ্জিন এবং কিছু গোলা-বারুদ উদ্ধার করে। পুলিশ, বিমানবাহিনী ও জেলা প্রশাসনের ধারণা, বিমানটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। উল্লেখ্য, রেজাউল করিমের বাড়ি লালমনিরহাট বিমানবন্দর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে মাহেন্দ্রনগর গ্রামে।
আরো উল্লেখ করার ব্যাপার, লালমনিরহাট বিমানবন্দরটির প্রতিষ্ঠা ওই যুদ্ধকালেই, অর্থাৎ ১৯৩৯-৪০ সালে। ওই যুদ্ধে বিমানবন্দরটি ব্যবহৃত হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে এটি পরিত্যক্তই ছিল। শেষে ২০১৯ সালে এখানে দেশের প্রথম অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং (মহাকাশ প্রকৌশল) বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর নাম রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়।
ঘটনাস্থল: নিধিয়ার চর
১৯৪২ সালের ১০ জুন। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের নিধিয়ার চর গ্রামে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। সহসা বিকট শব্দ শুনে চমকে উঠল গ্রামবাসী। তারপর দেখল দুটি যুদ্ধবিমান। একটি আরেকটিকে ধাওয়া দিচ্ছে। একপর্যায়ে পেছনের বিমান থেকে একটি গোলা সামনের বিমানটিকে আঘাত করে, এতে সেটিতে আগুন ধরে যায়। বিমানটি ব্রহ্মপুত্র নদের ধারের একটি গ্রামের ওপর পড়ে। গ্রামবাসীরা দৌড়ে গিয়ে দেখেন বিমানটিতে আগুন তখনো নেভে নাই। তিন ঘণ্টা পর তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে পুরো ঘটনাস্থল পুলিশ দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। তারপর যন্ত্রাংশগুলো উদ্ধার করা হয়।
বিমানটির পাইলট ছিলেন রস জেরাল্ড গ্রেগরি। তাঁর জীবনের গল্প লিখেছেন লন্ডনের ক্রীড়া সাংবাদিক ডেভিড ফ্রিথ। বইটির নাম 'রস গ্রেগরি: দ্য স্মাইলিং ক্রিকেটার'। গ্রেগরি তাঁর দিনপঞ্জিতে যুদ্ধকালের নানা অভিজ্ঞতা লিখে রাখতেন। দিনপঞ্জিটি এক বন্ধুর মাধ্যমে নিজের দেশ অষ্ট্রেলিয়াতে পাঠিয়ে দেন তিনি। বহু বছর পরে এক নিলামঘরে সেই ডায়েরির সন্ধান পান ফ্রিথ। ডায়রিসহ গ্রেগরির সঙ্গে সম্পর্কিত আর সবকিছুই কিনে নিলেন ফ্রিথ। এরপর গ্রেগরির পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করলেন। তাদের সাক্ষাৎকার নিলেন। জোগাড় করলেন বেশ কিছু দুর্লভ ছবি। এ সবকিছু একসঙ্গে করে লিখে ফেলেন বইটি।
তথ্য খুঁজতে বাংলাদেশেও এসেছিলেন ফ্রিথ। আসলে ফ্রিথ গিয়েছিলেন আসামে। কারণ নথিতে গ্রেগরির চালানো বিমানটির ধ্বংসস্থলের জায়গায় ভারতের আসামের নামই ছিল। কিন্তু সেখানে কিছু না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে চলে আসেন নিধিয়ার চরে। আর এখানেই মেলে তার সব প্রশ্নের উত্তর।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়া গ্রেগরি ছিলেন রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান এয়ারফোর্সের পাইলট অফিসার। মিত্রশক্তির অধীনে ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেন।
গ্রেগরি কিন্তু অষ্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দলেরও সদস্য ছিলেন। খেলেছেন অ্যাশেজ টেস্টও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়ার আগে তিনি ৩৩টি ক্রিকেট ম্যাচে ১টি সেঞ্চুরি ও ১৭টি হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন।
জলাশয়ে
এবারের বিমানটি জাপানের। সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার ধানক্ষেতে এটি পাওয়া গেছে। গল্পটি জানেনও অনেকে। নবীগঞ্জ উপজেলার শ্রীমতপুর কালিয়ারভাঙ্গা গ্রামের মধ্যবর্তী নীতনি বিলে এটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। সময়কালটা ১৯৪২। মিত্রবাহিনীর বিমান আক্রমণ করতে এসে জাপানের বিমানটি নিজেই ধরাশায়ী হয়।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ইঞ্জিনের গণ্ডগোলে বিমানটির ওই পরিণতি। স্থানীয়রা বিমানের ডানার কিছু অংশ খুলে নিয়েছিল। বাকিটুকু অনেকদিন ছিল জলের তলে বন্দি হয়ে। তবে কালের পরিক্রমায় জলাশয়টি ধানক্ষেত হয়ে উঠলে বিমানটি উদ্ধার করা যায়।
শ্রীমতপুর গ্রামের মাহতাব মিয়ার বয়স এখন ৯৫। ওইদিনের ঘটনার স্মৃতি তার কাছে এখন অনেকটাই ধূসর। বলছিলেন, 'সেদিন সকালে একটি যুদ্ধ বিমান আকাশে কয়েকবার চক্কর দিচ্ছিল। এক পর্যায়ে বিকট শব্দে বিমানটি বিলের মধ্যে পড়ে যায়। আমরা সবাই দৌড়ে যাই। তখন ভেতরে কোনো মানুষ পাওয়া ছিল না। তৎকালীন কিছু সরকারি কর্মকর্তা খবর পেয়ে এখানে ছুটে আসেন। তারা বিধ্বস্ত বিমান থেকে কিছু মালপত্র সরিয়ে এনে তৎক্ষণাৎ পুড়িয়ে দেন।'
লোকমুখে শোনা যায়, একবার স্থানীয় দুই জেলে নীতনি বিলে মাছ ধরতে যান। সেদিন তারা মাছের পরিবর্তে কৌটাসদৃশ একটি জিনিস পান। তাদের মধ্যে একজন কৌতূহলবশত কৌটাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করায় তা তৎক্ষণাৎ বিস্ফোরিত হলে তিনি মারা যান। অপরজন চোখে গুরুতর আঘাত পেয়ে অন্ধ হয়ে যান।
পরে আরেকবার একই গ্রামের খালিক মিয়া বিমান থেকে বলের মতো কিছু বস্তু পেয়েছিলেন। তিনি সেগুলোকে খেলনা ভেবে বাড়িতে নিয়ে এসে রোদে শুকাতে দেন। একবার জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় তিনি কুপি বাতির কাছে বলের মতো বস্তুটির চাবি মোচড় দিলে তা বিস্ফোরিত হয়। খালিক ঘটনাস্থলেই মারা যান। তারপর থেকে গ্রামের লোকজন বিমানটির আশপাশে যেতে ভয় পেত।