জলবায়ুর প্রভাবে হুমকির মুখে লক্ষ্মীপুরের সয়াবিন
‘নারিকেল, সুপারি ভরপুর সয়া-ইলিশের লক্ষ্মীপুর।’ উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর নামের সঙ্গে চারটি ঐতিহাসিক পণ্যের নাম যুক্ত থাকলেও ‘সয়াল্যান্ড’ নামে লক্ষ্মীপুরকে ব্র্যান্ডিং করিয়েছে সয়াবিন। ওয়ার্ল্ড এটলাসের সর্বশেষ (২০১৮) তথ্যমতে, সয়াবিন উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৬তম। আর বাংলাদেশে সয়াবিন উৎপাদনে প্রথম স্থানে রয়েছে লক্ষ্মীপুর।
২০১৭ সালে পাঁচ উপজেলা নিয়ে গঠিত লক্ষ্মীপুর জেলা ‘সয়াল্যান্ড’ নামে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। বিগত বছরগুলোতে সয়াবিন থেকে লক্ষ্মীপুরের বার্ষিক গড় আয় ছিল ৩ কোটি টাকা।
কৃষকসহ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গত ১০ বছরের মধ্যে চলতি বছর লক্ষ্মীপুরে সয়াবিন উৎপাদন চরম হুমকিতে পড়েছে। এ বছর জেলায় ৫৩ হাজার ২৩৮ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলার ১০০ হেক্টর জমিতেও সয়াবিনের চারা দেখা যায়নি।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, রবি মৌসুমে সয়াবিন বপণের শেষ সময় ১৫ জানুয়ারি। ফলে এ বছর লক্ষ্মীপুরের বিশাল অঞ্চলে সয়াবিন চাষ সম্পূর্ণ অশ্চিয়তার মধ্যে পড়েছে।
সয়াবিন চাষে সংকটের জন্য চাষীরা অসময়ের বৃষ্টি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দায়ী করেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছর (২০১৯) সারাদেশে উৎপাদিত সয়াবিনের ৫৯.৮০ ভাগ হয় লক্ষ্মীপুরে। ২০১৮ সালে উৎপাদিত হয়েছিল ৬৫ ভাগ, ২০১৭ সালে ৬০ ভাগ এবং ২০১৬ সালে ৫০ ভাগ। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর লক্ষ্মীপুরে সয়াবিন উৎপাদন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছর (২০১৯ সাল) লক্ষ্মীপুর জেলায় ৪৮ হাজার ৫৪৫ হেক্টর জমিতে ৮৬ হাজার ৪১০ টন সয়াবিন উৎপাদিত হয়। এ সময় সারাদেশে ৮০ হাজার ৪২২ হেক্টর জমিতে এক লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ টন সয়াবিন উৎপাদন হয়। এ তথ্যমতে গত বছর সারাদেশে উৎপাদিত সয়াবিনের শতকরা ৫৯.৮০ ভাগ সয়াবিন লক্ষ্মীপুরে উৎপাদন হয়।
অন্যদিকে গত বছর কৃষক পর্যায়ে সয়াবিন সর্বোচ্চ বিক্রি হয়েছিল টনপ্রতি ৩৭ হাজার ৫০০ টাকায়। সে হিসেবে গত বছর সয়াবিন থেকে লক্ষ্মীপুরের আয় হয়েছিল ৩২৪ কোটি টাকা।
স্থানীয় কৃষক এবং কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীরা জানান, ২০১৯ সালের আগের চার বছরই ফসল কেটে ঘরে তোলার কয়েকদিন আগে কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টির কবলে পড়ে সয়াবিন। এতে হাজার হাজার কৃষক পুঁজি হারায়। অনেকেই ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে।
রামগতি উপজেলার চর বাদামের কৃষক বংশীধারী ভৌমিক বলেন, আগে রবি মওসুমে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জেলার সকল জায়গায় সয়াবিনের বীজ বপন হতো। তবে এ বছর বৃষ্টির কারণে ফেব্রয়ারির মাঝামাঝিতে এসেও বীজ বপন করা যায়নি।
মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) সয়াবিন উৎপাদনের অন্যতম উপজেলা কমলনগরের চর লরেঞ্চ, চর কালকিনি, তোরাবগঞ্জ এলাকার মাঠ ঘুরে কোথায়ও এক হেক্টর জমিতেও সয়াবিনের চারা দেখা যায়নি। রামগতি, লক্ষ্মীপুর সদর এবং রায়পুর উপজেলার চিত্রও একই রকম।
কমলনগর চর মার্টিন গ্রামের কৃষক আলী হোসেন জানান, তিনি এ বছর ২০ একর জমিতে সয়াবিন চাষের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু তার অধিকাংশ জমিতে এখনও কাঁদা পানি। এরই মধ্যে সয়াবিনের মওসুম শেষ। ফলে এবার সয়াবিন চাষ করলে ফসল তোলার আগেই বৃষ্টির মুখে পড়তে হবে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, এ মৌসুমে লক্ষ্মীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় সয়াবিনের চাষ হওয়ার কথা। কিন্তু গত বছরের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অসময়ের তুমুল বৃষ্টিতে রবি ফসলের জমি পানিতে ডুবে যায়। পরে সে পানি শুকাতে না শুকাতে আবারো ৩-৫ জানুয়ারি বৃষ্টি হয়। সবশেষে ২৯ জানুয়ারি লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন স্থানে আবারো হালকা বৃষ্টি নামে। সব মিলিয়ে তিন বারের বৃষ্টির পর অধিকাংশ সয়াবিন চাষের জমিতে পানি জমে যায়। ফলে কবে সয়াবিন রোপণ হবে এবং বর্ষা মৌসুমের আগে ফসল ঘরে তোলা যাবে কি না- এমন দুশ্চিন্তায় রয়েছেন কৃষকরা।
কমলনগরের তোরাবগঞ্জ বাজারের বীজ ব্যবসায়ী আবদুল বাতেন জানান, কৃষকরা এবার সয়াবিন বীজ কিনছে না। বীজ না কেনার কারণে এবার তিনি বড় রকমের ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
রায়পুরের চর আবাবিল ইউনিয়নের কৃষক কামাল বলেন, তিনি সয়াবিনের জমিতে এবার পেয়াঁজ রোপণ করবেন।
কৃষকদের সঙ্গে একমত হয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারাও। রামগতি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা ছালেহ উদ্দিন বলেন, জানুয়ারির পরে সয়াবিন চাষ করলে ফলন ঘরে তুলতে জুন মাস চলে আসবে। তখন বর্ষা এসে যাবে। এ ক্ষেত্রে তিনি কৃষকদের অল্প সময়ে ফলন আসা, পেয়াঁজ, রসুন, ভুট্টা, মুগ, অহড় ডাল চাষের পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) নোয়াখালী অঞ্চলের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ মহীউদ্দীন চৌধুরী বলেন, অসময়ে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত এবং ঝড় মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। আর জলবায়ু পরিবর্তনের সে প্রভাব সরাসরি রবি শস্য সয়াবিনের ওপর আঘাত হেনেছে। এতে সয়াবিন চাষ তীব্র সংকটের দিকে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এর কারণ হিসেবে ‘সয়াল্যান্ড’ প্রসিদ্ধ একক রবি ফসলের জেলা লক্ষ্মীপুরে সয়াবিন চাষ বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তিনি স্বল্প মেয়াদী সয়াবিন জাত আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।