একালের ভিসিদের নিয়ে কোনো লেখাই নতুন মনে হয় না!
'অতীতে ছিলেন ভিসি শ্রদ্ধার আসনে
ভার্সিটি চালাতেন মমতা ও শাসনে
আজকাল ভিসি মানে মাস্তান। প্রীতি নাই
সম্মান-মর্যাদা-নীতি নাই-নীতি নাই
ইদানীং ভিসি মানে কৌতুক শিল্পী
বিনোদন আইটেম। রসে ভরা জিলপি
বাজাও তালিয়া জোরে তালি দাও তাল্লি
একেকটা ভিসি যেন সিনেমার চাল্লি
ভিসিদের কাজটা কী? শুধু লোক হাসানো?
এর থেকে মুক্তির আছে কোন আশা?
আশা নাই আশা নাই
ক্ষোভ আর নিন্দার ভাষা নাই ভাষা নাই
..........লুৎফর রহমান রিটন (অটোয়া, ০৫ নভেম্বর, ২০১৯)
প্রিয় লেখক আহমদ ছফার 'গাভী বিত্তান্ত' যারা পড়েছেন তাদের কাছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ভিসি'দের নিয়ে কোন লেখাই নতুন মনে হবে না! মনে হবে এই লেখা আগেই পড়েছি! কারণ সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ভিসি'রা নাকি পাবলিকের নন, সরকারের! আপামর 'ছাত্রদের' নন, ভিসিরা নাকি সরকারি দলের শিক্ষক নেতা ও সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের। তাই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আপামর ছাত্ররা নামে রাস্তায়, তাদের লাঠিপেটা করে পুলিশ, তাদের ওপর হামলে পড়ে সরকারি দলের ছাত্রসংঠনের নেতাকর্মীরা। আইয়ুবের আমল থেকে এই তল্লাটে যেন একই নাটকের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। যা করতো আইয়ুব খানের ছাত্র সংগঠন 'এনএসএফ' (ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন), স্বাধীনতার পর থেকে সেই একই নাটকের বাস্তবায়ন করে আসছে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনগুলো। ভিসি সাহেবরা এদের রক্ষাকবচ। তাই পুরোনো পত্রিকা, নিজের পুরোনো লেখা এবং বিভিন্ন দৈনিকের সূত্র ধরে যে তথ্য-উপাত্ত মিলবে সেগুলোও পুরোনো মনে হবে বিধায় পাঠকের কাছে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি! গত এক দশকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের কাজের কিছু ফিরিস্তি তুলে ধরলেই বোঝা যাবে...
এক. পদত্যাগ এদেশে দুর্বলের শেষ অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। দলীয় শিক্ষকদের নিয়ে দলবাজি, লোভনীয় পদের জন্য তদবিরবাজি, বিদেশ ভ্রমণ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়া এসবই কিছু কিছু শিক্ষকের ধ্যানজ্ঞান। এসব ঠিকঠাক রাখতে এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা পদত্যাগ করতে চান না। আহমদ ছফার বিখ্যাত উপন্যাস 'গাভী বিত্তান্ত' পড়লে বোঝা যায় যে এখন আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমাজ বলে কিছু নাই। আছে হলুদ, বেগুনি, ডোরাকাটা (সাদা বা নীল) এইসব দল। আপনার দল যত ভারি আপনি তত বড় শিক্ষক, আপনার ভিসি হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। আপনি কোথায় কবে গবেষণা করলেন, দেশ-বিদেশের কোন জার্নালে আপনার কোন গবেষণাকর্ম ছাপা হলো এসবে কারো আর খেয়াল নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কোণে নীলক্ষেত নামে একটা জায়গা আছে। যা নিয়ে গবেষণা করতে চান সব নাকি ঐখানে পাওয়া যায়। টাকা দিয়ে কিনবেন, প্রয়োজনে কপি-পেস্ট করে জমা দেবেন। কয়জন এমন 'টুকলিফাই' করে ধরা পড়েছে সেই তালিকা নিয়ে কেউ নাকি ঘাটায় না! আপনার দল বড় হলেই সাতখুন মাফ।
দুই. 'গাভী বিত্তান্ত' উপন্যাসের ভিসি মিঞা মোহাম্মাদ আবু জুনায়েদ জমির দালালদের সাথে মিশতে পছন্দ করতেন, পছন্দ করতেন কম দামে জমি কিনতে। কিন্তু যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বহুজাতিক কোম্পানির পরামর্শক, এনজিওর ন্যাওটা হতেন ভিসি জুনায়েদ তাদের সম্পর্কে নীচু ধারণা পোষণ করতেন। একালের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন সরকার বা সরকারি দলের 'গুডবুকে' থাকতে।
তিন. এদেশে ভিসিদের কর্মকাণ্ড কিংবা কথোপকথন ভাইরাল হয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. রফিকুল হকের এক 'অডিও' ফাঁস এর পর ভাইরাল হয়েছিল। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তৃতীয় শ্রেণীর নারী সহকর্মীর সাথে তার কথোপকথনের কয়েকটি অডিও ভাইরাল হলে এর সাথে যুক্ত হয় ৩০৭ জন কর্মচারী নিয়োগের অনিয়ম এবং তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
চার. এভাবে ভাইরাল হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির এক ডায়লগ। তিনি বলেছিলেন- 'এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে দশ টাকায় এক কাপ চা (উচ্চারণ ছা), একটা সিঙ্গারা (ছিঙ্গারা), একটা সমুচা (ছমুচা) পাওয়া যায় যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানতে পারলে গিনেস বুকে রেকর্ড হবে!' বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে নাম ওলটপালট ও চিরকুট কেলেংকারি নিয়েও তোলপাড় হয়েছিল। নাম ওলটপালটের কেলেংকারি বাদ দিলেও ভিসি আখতারুজ্জামানের এই চিরকুটের বদৌলতে ছাত্রলীগের কয়েক ডজন কর্মী মাস্টার্সে কোন লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভা ছাড়া ভর্তির সুযোগ পান এবং ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হতে পারেন। অনৈতিক এমন সুযোগ প্রদানের পরও তিনি বহাল তবিয়তে আছেন কারণ সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের ইচ্ছেকেই তিনি হয়তো বাস্তবে রূপদান করেছিলেন!
পাঁচ. ভাইরাল হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফারজানা ইসলামের কথোপকথন। এটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেট থেকে এক কোটি ষাট লাখ টাকা ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয়া সংক্রান্ত। অডিওতে একজন স্বীকার করেছেন যে তিনি টাকা পেয়েছেন। তিনি একাধিক পত্রিকা ও টেলিভিশনকে বলেছেন টাকা দেয়ার আলোচনার সময় ভিসির স্বামী ও ছেলে উপস্থিত ছিলেন। তারা এটাকে ঈদ সেলামি বলে উল্লেখ করেছিলেন। ভিসি তারপরও দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ছয়. টাকা ভাগ-বাটোয়ারার অডিও ফাঁসের মত আরও একটি অডিও ভাইরাল হয়েছিল। এই ভিসির নাম খোন্দকার নাসিরউদ্দীন। তিনি এক ছাত্রীর সাথে যে ভাষায় কথা বলেছেন তা শুনলে আঁতকে উঠতে হয়। ভিসির ভাষ্য অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় না খুললে মেয়েটা নাকি রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াত। বিশ্ববিদ্যালয়ে কী কাজ হয় সেটা ছাত্রীর বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছেন। খোন্দকার নাসিরউদ্দীন আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই এখন।
সাত. ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল আরেক ভিসির। সেটা ছিল ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ সাহেবের নাচানাচির ভিডিও। ভিসি হিসেবে নিয়োগ পাবার অন্যতম শর্তই ছিল নিয়মিত ক্যাম্পাসে উপস্থিত থাকা কিন্ত বছরের বেশিরভাগ সময়েই তিনি ক্যাম্পাসে উপস্থিত থাকতেন না। ২০১৮ সালে ২৯৫ দিনই তিনি ক্যাম্পাসে ছিলেন না। ২০১৭ সালে ১৩১ দিন ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত ছিলেন। এমন অনুপস্থিতির হার পরবর্তী দুই বছরেও অব্যাহত ছিল। এছাড়া ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি, ইউজিসির নির্দেশ অমান্য করে জনবল নিয়োগ, স্বজনপ্রীতি করে একাধিক লোক নিয়োগ, একসাথে অনেক পদ আঁকড়ে রাখা, উন্নয়ন কার্যক্রমে আর্থিক অনিয়মসহ আরও অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নিলেও এমনভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নীরবে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আনোয়ারুল আজিম আরিফ।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের আরও অনেক 'আলোচিত কার্যকলাপ' আছে। ২০১৯ এর শুরুতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এস এম ইমামুল হক আন্দোলনকারী কয়েকজন শিক্ষার্থীকে 'রাজাকারের বাচ্চা' বলে সম্বোধন করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নামে। আন্দোলনের একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয় এবং ছুটিতে থাকাকালীন তার ভিসির মেয়াদ শেষ হয়। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও আর্থিক অনিয়মের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে নির্দেশ দেয় ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন বা ইউজিসি। ইউজিসির টিম নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারেনি লেলিয়ে দেয়া 'মাস্তান ও সন্ত্রাসী'দের মহড়ার কারণে!
এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। সেখানে ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে ফরিদ উদ্দিন যা তা বলেছেন- 'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা নাকি সারারাত বাইরে থাকে, বউ হিসেবে কেউ তাদের নিতে চায় না'। ফরিদ উদ্দিনের বিবিধ কার্যকলাপে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অনশনের পথ বেছে নিয়েছেন। তারা বলছেন করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মেসের ভাড়া দিতে বলা হয় ছাত্রীদের। ডাইনিং ছাড়া খাবারের জন্য ১৬-১৭টি টংঘর যেখানে খাবার পাওয়া যেত সেসব বন্ধ থাকায় সমস্যায় ছিল ছাত্রীরা। হলের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও খাবার পানির অপ্রতুলতা নিয়ে আন্দোলনে নামলে পুলিশের লাঠিপেটার সম্মুখীন হয় ছাত্ররা। অজ্ঞাতনামা ২০০-৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করলেও ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন চলছে এখনও।
নিছক দলবাজি না করলে সমস্যায় পড়তে হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভিসি বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন এমন ছয়জন শিক্ষকের মোবাইল সিম ব্লক করা হয়েছিল। আবার খোলা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির পাস্তুরিত তরল দুধ সংগ্রহ করে সেটা নিয়ে গবেষণা ও ঐসব কোম্পানির দুধে মানবদেহের জন্য যে ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে তা দেখিয়ে দেবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের অবস্থা কী হয়েছে তা অনেকেই জানেন!
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ জাহাঙ্গীরনগরের ভিসি ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের একাংশ এবং ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে নেমেছিলেন যা পত্রিকা ও টেলিভিশনের শিরোনাম হয়েছিল। সেই সময়ে ছাত্রছাত্রীরা পুঁথিগানের মতো করে একটি গান গাইতেন মিছিল শেষে। গানটির কয়েক লাইন এমন-
তারা সবার আগে ঠেকায় মাথা মাননীয়র ঠ্যাংয়ে
আর বুক চিতিয়ে নামটি লেখায় চাটুকারের গ্যাংয়ে
তারা সুবিধাপন্থী
তারা সুবিধাপন্থী শুধুই শান্তি ডিপার্টমেন্ট আর হলে
সিট সংকট আর গবেষণা দুর্জনেরাই বলে
তারা ব্যবসা বোঝে
তারা ব্যবসা বোঝে সুযোগ খোঁজে বাড়ায় ফর্মের দাম
গরীব দুঃখীর টাকা মেরে আনে মায়ের নাম...
ভাইরা টেন্ডার খাবে বিল্ডিং গড়বে ভরবে পকেট ভাই
গাছের গায়ে কুড়াল পড়লেও ২% চাই...
দিল্লীতে একবার মোদি প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ পাঠালে দিল্লীসহ সারা ভারত ফুঁসে উঠেছিল। ছাত্রছাত্রীরা নেমেছিল রাস্তায়। তখন আমীর আজিজের লেখা একটা কবিতা হয়ে উঠেছিল ভারতের কন্ঠস্বর। কবিতার কয়েকটা লাইন দিয়ে লেখাটা শেষ করি-
তোমরা কালো পদ্ম লেখো
আমরা লিখব লাল গোলাপ
তোমরা জমিনে জুলুম লেখো
আকাশে লেখা হবে বিপ্লব
সব মনে রাখা হবে
সবকিছু মনে রাখা হবে, সব
তোমাদের লাঠিগুলিতে নিহত হয়েছে যে বন্ধুরা আমাদের
তাদের স্মরণে হৃদয় বিরান করে রাখা হবে
সব মনে রাখা হবে, সব