শিক্ষার্থীদের অনশন: দাবি না মেনে পার পাওয়া যাবে না!
সর্বশেষ খবরে ( ২৪ জানুয়ারি, ২০২২) জানা গেছে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ মোবাইল ফোনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের কাছে ছাত্রীদের নিয়ে করা তার অশালীন, নারীবিদ্বেষী বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছেন। জাবির জনসংযোগ কার্যালয়ের পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আঠারো জানুয়ারি তার বক্তব্যের একটি অডিও ক্লিপ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সবাই এই বক্তব্যের কথা জানতে পারেন এবং ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে এরকম কোন নারীবিদ্বেষী ব্যাক্তি থাকবেন, সেটাই ঘোরতর আপত্তির বিষয়। এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে নিজের ভুল উপলব্ধি করবার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা। ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিতে খুব দেরি করে ফেলেছেন তিনি। এখন বিষয়টি আর ক্ষমা চাওয়া বা না চাওয়ার বাইরে চলে গেছে। এরই মধ্যে আন্দোলন অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। ঘটনাও ঘটেছে অনেক।
আমি সংহতি জানাচ্ছি সকল আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের। তাদের দৃঢ়তা এবং অনড় থাকার সংকল্প বাংলাদেশের তরুণদের সম্পর্কে আমাদের আশাবাদী করে তোলে। তাদের অনশন কর্মসূচীর প্রতি সংহতি। অনশন কর্মসূচী কষ্টের কিন্তু প্রশংসনীয়। অথচ এই আন্দোলন এতোদূর গড়ানোর কথা ছিল না।
এই আন্দোলন শুরু থেকেই নারীদের ইস্যু। নারীর প্রশ্ন। শুরু হয়েছিল ১৩ জানুয়ারি থেকে, বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরি হলের ছাত্রীদের তিন দফা দাবিতে। এই দাবির মধ্যে হলের প্রভোস্ট কমিটির পদত্যাগ চাওয়া হয়েছিল। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তারা উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করলে পুলিশ ডাকা হয় এবং শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কোন প্রকার উসকানি ছাড়াই পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুঁড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিশেষ করে ছাত্রীদের ওপর পুলিশের বর্বর হামলা করা হয়, যা শিক্ষার্থীদের আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। এতে চল্লিশজনের বেশি শিক্ষার্থী আহত হয়েছে, তার মধ্যে ছাত্রীদের সংখ্যাই ছিল বেশি। এমনকি পুলিশ ৩০০ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলাও করে। বিক্ষুব্ধ হয় সাধারণ শিক্ষার্থীরাও। তারা ভিসি অপসারণের এক দফা দাবি তোলে এবং আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। কারণ এই কয় দিনেও প্রশাসন বা কেউই তাদের দাবির প্রতি ভ্রুক্ষেপও করে নি। ছাত্রীদের বিষয় ছিল বলেই সেটা অবহেলা করা হয়েছে, বা সহজ ভাষায় বললে 'পাত্তা' দেয়া হয় নি, তাই কি? মেয়েদের সম্পর্কে উপাচার্যের মন্তব্য নারীর প্রশ্নে অবহেলা শুধু নয়, বোঝা গেল এই নারীবিদ্বেষ নামক সমাজের গভীর অসুখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাবানদের মধ্যে সংক্রমিত রয়েছে। এর বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের লড়াই ছিল ন্যায্য, যা আসলে শুধু শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লড়াই হয়ে থাকলো না, সারা দেশের লড়াই হয়ে উঠলো।
ভিসির নির্দেশে ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশের ন্যাক্কারজনক ও বর্বর হামলা হয়েছে। এটা কোনভাবেই মেনে নেয়ার বিষয় নয়। দাবি মেনে নেয়া তো দূরে থাক, আন্দোলনকারীদের সাথে কোন কথাই বলেনি প্রশাসন। শিক্ষকরা তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করলেও তাদের দাবি আদায়ে কোন প্রকার সহায়তা করেন নি। এরপর ১৯ জানুয়ারি শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশন শুরু করেছে যা এই ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত চলছে। আটাশজন শিক্ষার্থী অনশন করছেন, ১৫ জন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন। তাদের অবস্থার ক্রমাগত অবনতি ঘটছে। কিন্তু তারা এখনও তাদের দাবিতে অনড় রয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সাথে শিক্ষার্থীরা কথা বলতে চেয়েছিলেন। খুব দুঃখের বিষয় হচ্ছে, শিক্ষামন্ত্রী ঢাকা থেকে সিলেটে একটু কষ্ট করে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলেন নি। তিনি তার পরিবারের অসুস্থতার কথা বলেছেন। তিনি কোন প্রতিনিধিও পাঠান নি। বরং উলটো এই অনশনরত শিক্ষার্থীদের তিনি ঢাকা আসার প্রস্তাব দিয়েছেন। এই প্রস্তাব চরম অদূরদর্শিতা, অমানবিক এবং আন্দোলনের প্রতি অসম্মানজনকও বটে। তবুও শিক্ষার্থীরা তার সাথে ভার্চুয়ালি আলোচনা করেছেন। যা হবার তাই হয়েছে। কোন ফল পাওয়া যায় নি। কারণ দাবি-দাওয়ার যৌক্তিকতা উপলব্ধি এবং তা মেনে নেয়ার বিষয়ে আশ্বাস না থাকলে আলোচনা কখনই ফলপ্রসূ হতে পারে না। এখানেও শিক্ষামন্ত্রী কৌশল খাটাতে চেয়েছেন। আন্দোলনের গুরুত্ব বোঝেন নি। শিক্ষামন্ত্রী নিজেকে একজন 'মা' বলে পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তিনি একজন নারী হিসেবে কী করে উপাচার্যের নারীর প্রতি অসৌজন্যমূলক বক্তব্য মেনে নিচ্ছেন সেটা বোধগম্য হলো না। তাকে একবারও বলতে শোনা যায় নি উপাচার্যের বক্তব্য ঠিক না। বক্তব্যের নিন্দা জানান নি।
আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা, তাদের আন্দোলনের একটি ভাষা হচ্ছে অনশন। তারা না খেয়ে থাকছে। না খেয়ে নিশ্চয়ই বেশিদিন বেঁচে থাকা যায় না, মৃত্যু না হলেও সুস্থ নিশ্চয়ই থাকা যায় না। একজন ডাক্তার হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী অন্যদের চেয়ে ভাল বুঝবেন এই আশা করা যায়। উলটো উপাচার্যের পক্ষের লোকেরা আন্দোলনকারীদের অনশন এবং তাদের দাবিদাওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। যেন বা তারা অনশন করছে না, ভান করছে। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করছেন যে, তাদের অনশনের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা তার জবাব গণমাধ্যমেই দিয়েছেন। অপরপক্ষ থেকে বলা হয়েছে এর পেছনে 'তৃতীয়' পক্ষ আছে । এটাও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি অবমাননা। কারণ বোঝানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যৌক্তিক নয়, অন্যের বা বাইরের প্ররোচনায় তারা এসব করছে। শিক্ষামন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী এর মধ্যে রাজনীতি খুঁজতে ব্যস্ত রয়েছেন, শিক্ষার্থীদের কষ্ট তাদের চোখে পড়ছে না। অন্যদিকে তাদের চোখে উপাচার্য, প্রভোস্টসহ সংশ্লিষ্টরা সবাই 'নির্দোষ'!!
শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে, এটাকে নাশকতামূলক কাজ বলে অনেকে সমালোচনা করেছেন। হ্যা, এটা কাম্য নয়, কিন্তু পরিস্থিতিটা এই স্তরে শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা করে আনেননি। শিক্ষার্থীরা গণমাধ্যমের কাছে পরিষ্কার করেছেন যে এটা করতে তারা বাধ্য হয়েছে্ন, কারণ তারা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, তারা ঠিকই বলেছেন। এখন অনেকে পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে। উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়ে কোন আশ্বাস শিক্ষার্থীদের কর্তৃপক্ষ দেয় নি।
শিক্ষার্থীরা অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন, আমরণ। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এতোগুলো তাজা প্রাণ।
কিন্তু আন্দোলনের চরিত্র কিছুটা বদলে গিয়েছে। বর্তমানে সবার আলোচনায় উপাচার্যের পদত্যাগ বা অপসারণের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, কিন্তু এর মাঝে চাপা পড়ে যাচ্ছে নারীর প্রতি অশালীন ইঙ্গিত ও মন্তব্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নারীবিরোধী আচরণ যেভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে তাতে আতংকিত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এর আগে আমরা দেখেছি একজন প্রতিমন্ত্রী অশ্লীল মন্তব্য করেছেন, এমনকি তার স্ত্রীর প্রতিও নির্যাতন চালিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও কিছুই হয় নি। তেমনি একজন উপাচার্য এমন মন্তব্য করছেন এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি সহিংস পদক্ষেপ নিয়েছেন, অথচ তার পদত্যাগের দাবি উঠলে আরো ৩৪ জন তার পক্ষে পদত্যাগ করার জন্যে এগিয়ে আসছেন। এরা সকলেই উপাচার্য!! বাংলাদেশের সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে দেখুন। তারাও নারীবিরোধী বক্তব্য সমর্থন করছেন। শুধু তাই নয়, নারীবিদ্বেষী উপাচার্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী নারী, কিন্তু তারও আচরণ বক্তব্য বা ভাষ্য এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ালো না।
এ থেকে শিক্ষণীয় কী? শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের বর্বরোচিত হামলা না হলে উপাচার্যের এই নারীবিদ্বেষী বক্তব্য নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য হতো না। এই আন্দোলন কোথাৎ, কীভাবে থামে সেটা এখন দেখার বিষয় বটে, কিন্তু এই পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে নারীর প্রশ্ন যথারীতি চাপা পড়ে যাচ্ছে।
নারীর মর্যাদা গুরুতর রাজনৈতিক ইস্যু। এই মর্যাদা আদায় করা দীর্ঘ লড়াই। কিন্তু যে ভরসাটুকু আমরা পাচ্ছি সেটা হলো তরুণদের মধ্যে এই বিষয়ে আগের চেয়ে সচেতনতা বেড়েছে। নতুন সংগ্রামী মেয়েরা সামনে এগিয়ে আসছেন। যা আমাদের আশান্বিত করে
আমরা আছি তাদের সঙ্গে। সর্বদা। সব সময়।
- লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী