ভারতের রাজ্যসভা নির্বাচনে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে বেওয়ারিশ গরুর হামলা
উত্তর প্রদেশে (ইউপি) নিজ বাড়ির উঠানে বসে চা খাচ্ছিলেন ৫৫ বছর বয়সী রাম রাজ। এমন সময় হুট করে এক বেওয়ারিশ গরু এসে তাকে আক্রমণ করে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে যায় উঠানে থাকা রাম রাজের নাতি-নাতনিরা। তারা চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও গরুর হাত থেকে দাদাকে রক্ষা করতে পারেনি।
সেই বেওয়ারিশ গরুর আক্রমণে ভয়াবহভাবে আহত হন রাজ। হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও পথেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
এরকম আক্রমণ এখন ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য, উত্তর প্রদেশে নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরু জবাই নিষিদ্ধ করায় গত কয়েক বছরে এ রাজ্যে গরুর সংখ্যা ব্যাপক বেড়ে গেছে। বেওয়ারিশ গরু ও তাদের আক্রমণ ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া রাজ্যসভা নির্বাচনেরও একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা গরুকে একটি পূজনীয় প্রাণী হিসেবে দেখেন। তবে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত কৃষকরা তাদের বয়স্ক গরুদের সবসময় কসাইখানায় বা অন্য কোনো উপায়ে বিক্রি করে এসেছেন।
"গরু যখন দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিত বা ক্ষেত চাষের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়ত তখন আমরা এদের বিক্রি করে দিতাম। সেই বিক্রির টাকা ছিল আমাদের কঠিন সময়ের জন্য সঞ্চয়," বলেন শিব পুজন নামের স্থানীয় এক ধান চাষি।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার তাদের ডানপন্থী হিন্দু এজেন্ডা অনুযায়ী গোহত্যার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। উত্তর প্রদেশসহ ভারতের ১৮টি প্রদেশে এখন গোহত্যা নিষিদ্ধ।
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নিজেও একজন কট্টরপন্থী বিজেপি নেতা। ২০১৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর বেশ কিছু কসাইখানা বন্ধ করেছেন তিনি। মহিষের মাংস রপ্তানির জন্য বিখ্যাত উত্তর প্রদেশের অর্থনীতিতে এর আগ পর্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল এ কসাইখানাগুলো।
এ অঞ্চলে গবাদি পশু ব্যবসায়ীদের প্রায় সবাই মুসলমান বা দলিত (নিচু বর্ণের হিন্দু)। এই ব্যবসায়ীদের উপরও ঘনঘন বিজেপি বা স্থানীয় ডানপন্থী গোষ্ঠীর কর্মীদের কাছ থেকে আক্রমণের ঘটনা ঘটে থাকে। এসব আক্রমণে অনেক ব্যবসায়ী নিহতও হয়েছেন।
যে কারণে গরুর ব্যবসাই ছেড়ে দিয়েছেন তাদের অনেকে। কৃষকরা যখন দেখেন গরু আর তার কোনো কাজে আসছে না, সেটির পিছনে বাড়তি খরচ না করে তারা তখন গরুকে এক জায়গায় নিয়ে ছেড়ে দেন।
তাদের এই বেওয়ারিশ গরুগুলোকে এখন প্রদেশের শহর ও গ্রামে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। কৃষক এবং স্থানীয়রা বলছেন, খাবারের অভাবে এরা দিন দিন আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। এমনই এক গরু রাম রাজের বাড়ির উঠানে ঢুকে পড়েছিল। তখন তিনি এবং তার পরিবারের সবাই ভয় পেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলে গরুটি তাকে আক্রমণ করে।
এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। শিব পুজন নিজেও সম্প্রতি এমন এক আক্রমণের শিকার হয়েছেন। নিজের ক্ষেত থেকে বেওয়ারিশ গরুদের তাড়াতে গিয়ে এই কৃষক নিজেই গরুদের তাড়া খান।
পুজন নিজে একজন একনিষ্ঠ হিন্দু। তার চোখেও গরু একটি পবিত্র প্রাণী। তবে সব গরুকে এভাবে রক্ষা করার সরকারি নীতি সমর্থন করেন না তিনি।
এছাড়া এসব বেওয়ারিশ গরু ফসল নষ্ট করছে, সড়ক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে এবং মানুষ খুন করছে বলেও জানান পুজনের মতো স্থানীয় কৃষকরা।
বিরোধী দলগুলো ইউপিতে এ বিষয়টি তুলে সরকারবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। ইউপি মূলত একটি গ্রাম-নির্ভর প্রদেশ, যেখানে ভোটারদের একটি বড় অংশ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত।
এই প্রদেশে বিজেপির মুখপাত্র সমীর সিং বলেন, এই সমস্যা মোকাবেলায় সরকার নতুন কৌশল গ্রহণ করার পরিকল্পনা করছে।
"এদেরকে তো বেওয়ারিশ গরু বলা উচিত না। কারণ এই প্রাণী নিজেই হিন্দু সংস্কৃতির অংশ। আমরা তো কখনো পরিবারের বয়স্কদের মরার জন্য রাস্তায় ছেড়ে দেই না। গরুকে কীভাবে রাস্তায় রাস্তায় মরার জন্য ছেড়ে দিতে পারি আমরা?" বলেন সিং।
এরকম বেওয়ারিশ গরুদের জায়গা দেওয়ার জন্য আদিত্যনাথ প্রশাসন লাখ লাখ টাকা খরচ করে অনেকগুলো গরুর আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। রাষ্ট্র পরিচালিত হাজার হাজার গরুর আশ্রয়কেন্দ্রের খরচ যোগাতে তারা অ্যালকোহলের উপর একটি বিশেষ করও বসিয়েছে।
কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করে দেখা যায় সেখানে খুবই মানবেতর পরিস্থিতিতে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে প্রাণীগুলোকে।
এরকম একটি আশ্রয়কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা শত্রুঘ্ন তিওয়ারি বলেন, "আমাদের এখানে ২০০টির মতো গরু আছে। এরচেয়ে বেশি রাখা সম্ভব না। কিন্তু এলাকায় ৭০০ থেকে এক হাজারের মতো বেওয়ারিশ গরু এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে।"
এদিকে বেওয়ারিশ গরুর হাত থেকে নিজেদের ফসল রক্ষা করতে অনেক কৃষক তাদের খামারে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করেছেন। তীব্র ঠাণ্ডা ও সাপের ভয়কে উপেক্ষা করে তারা পালা করে রাতভর মাঠের মধ্যে টহল দিয়ে থাকেন।
৬৪ বছর বয়সী কৃষক বিমলা কুমারী বলেন, "আমরা গ্রাম জুড়ে কৃষকদের একটি দল বানিয়েছি যারা পালা করে টহল দেয়। আমাদের জায়গায় সকালে একটি নতুন দল আসবে, তখন আমরা ঘুমাতে যাব।"
অনেক কৃষক এই সমস্যায় বিরক্ত হয়ে গেছেন। তারা নির্বাচন বয়কট করার কথা ভাবছেন।
"আমাদের সমস্যার সমাধান না হলে ভোট দিয়ে লাভ কী?" বলেন স্থানীয় কৃষক দীনা নাথ।
সূত্র: বিবিসি।