খাদির মতো ভাতনিক-ও, রাশিয়ার খেটে খাওয়া মানুষের স্বদেশী মোটা কাপড়
ইউরোপীয় বণিকের হাতে যখন ক্ষমতার লাগাম, তখন কপাল পুড়েছিল এদেশবাসীর। যন্ত্রচালিত ব্রিটিশ তাঁতযন্ত্রে বোনা কাপড় বাজারে চালাতে এদেশীয় তাঁতিদের ওপর নিপীড়নের কথাও আজ কারো অজানা নয়। এই অত্যাচারে হারিয়ে যায় বাংলার শত শত বছরের ঐতিহ্য মসলিন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজের মুনাফালোভী দৃষ্টি থেকে বাদ পড়েনি লবণের মতো পণ্যও।
তাই যখন ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয় তখন বিলেতি কাপড়ের পরিবর্তে স্বদেশী কাপড় পায় প্রাধান্য। খাঁদির মতো মোটা কাপড় পরা হয়ে ওঠে দেশপ্রেম ও বিদ্রোহের প্রতীক।
বাংলা, এমনকি ভারতবর্ষ থেকে বহুদূরের দেশ রাশিয়াতেও জনগণের মুক্তি আকাঙ্ক্ষায় জড়িয়ে পড়েছিল একটি বস্ত্রের বিবর্তন। তুলোয় বোণা পুরু এ জ্যাকেটের নাম ছিল- ভাতনিক। খ্যাতি ও কুখ্যাতি দুইই লাভ করে এটি ব্যবহারের ইতিহাস।
শুরু করা যাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই। ১৯৪২ সনে স্টালিনগ্রাদ শহরে জার্মান সেনাবাহিনীর ঐতিহাসিক পরাজয়ের আগপর্যন্ত ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি সোভিয়েত রাশিয়া। জানমালের বিপুল ক্ষতি করে এগিয়ে আসছিল হিটলার বাহিনী। কৃষিজমি সমৃদ্ধ ইউক্রেনসহ পূর্বের বিশাল অঞ্চল তারা দখল করে নেয়। একের পর এক সোভিয়েত রেজিমেন্ট নাৎসিদের সুশৃঙ্খল ও আধুনিক যুদ্ধ কৌশলে পরাজিত হচ্ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নজুড়ে দেখা দেয় খাদ্য ও বস্ত্রের চরম সংকট।
কিন্তু, শুধু অস্ত্র দিয়ে তো লড়াই চলে না। সেনাদের যেমন চাই অন্ন, তেমনি রাশিয়ার কুখ্যাত শীতের হাত থেকে সুরক্ষা। প্রথমটির অভাব কীভাবে পূরণ হয়েছিল সে অন্য ইতিহাস, কিন্তু রুশ সেনাদের গায়ে উঠে আসে ভাতনিক।
সস্তার এই পোশাক শীতের বিরুদ্ধে যেমন সুরক্ষা দিয়েছিল, ঠিক তেমনি পুরু বুননের কারণে শত্রু গোলার বিক্ষিপ্ত টুকরো (শার্পনেল) থেকেও রক্ষা করেছে ক্ষেত্রবিশেষে।
স্টালিনের রাশিয়ায় সেনাদের সাধারণ শীত পোশাক হিসাবে ১৯৩০ এর দশকেই ওভারকোটের নিচে ভাতনিক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। আর ১৯৪২ সালে এক আনুষ্ঠানিক নির্দেশনার মাধ্যমে লাল ফৌজে প্রাইভেট ও জুনিয়র স্টাফের মতো কনিষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের জন্যও ভাতনিক হয় বাধ্যতামূলক।
লাল ফৌজের নেতৃত্ব তখন রসদ সংকটে ভুগছিলেন,যা তাদের ভাতনিকের গণব্যবহারমুখী করে। তাছাড়া, যুদ্ধক্ষেত্রে পোশাকটির সুবিধাও তাদের নজরে আসে।
সেনারা যখন ফ্রন্টে নাৎসি বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখতে ব্যস্ত, তখন সমরাস্ত্র ও অন্যান্য একান্ত প্র্যয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনে কারখানা কর্মীদের দম ফেলার সুযোগ নেই। তারা দেশমাতৃকা রক্ষার যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন কারখানায় কাজ করেই। চাষিরা রাশিয়ার বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তরের শস্যক্ষেতে হাড়কাঁপানো হিমেল বাতাসে কাজ করে খাদ্য উৎপাদন করেছেন। এসব কর্মী ও চাষিদের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ভাতনিক জ্যাকেট।
স্টালিনের কুখ্যাত শ্রমশিবির বা গুলাগেরও সাধারণ পোশাক ছিল ভাতনিক। অবকাঠামো নির্মাণ কর্মীরাও ভাতনিক ব্যবহার শুরু করেন। মোদ্দা কথায়, সব সাধারণ মানুষ ও সেনাদের পরিধেয় হয় উঠেছিল এটি।
তখনও এটি আকার ও মান অনুসারে 'স্ট্যান্ডার্ডাইজড'করা হয়নি। যুদ্ধের ডামাডোলে তা হয়তো করা সম্ভবও ছিল না। ফলে শ্রমশিবির গুলাগের গারিচালক, কর্মী থেকে শুরু করে ছাত্ররাও নানান রকমের ভাতনিক পরত। পার্থক্য ছিল কেবল রঙে। যেমন সেনাদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল খাকি রঙ। সাধারণ মানুষ পরতো নীল, ধূসর, বাদামি রঙা জ্যাকেট। কয়েদিদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল কালো রঙ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু বিখ্যাত অবকাঠামো যেমন-বৈকানুর কসমোড্রোম, ৪ হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বৈকাল-আমুর ব্রডগেজ রেলপথসহ ছোটবড় অজস্র অটোমোবাইল কারখানা ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করেছিল ভাতনিক পরা কর্মীবাহিনী।
বাস্তব চাহিদা থেকে এই জ্যাকেটের উদ্ভব ও প্রচলন শুরু হলেও ধীরে ধীরে তাতে শৈল্পিক ছোঁয়া আনেন সোভিয়েত নারীরা। এক সময় বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত ভাতনিককে আরো ফ্যাশনমুখী করার উদ্যোগও নেওয়া হয়। সোভিয়েত নারীরা এতে নানান রকমের কলার যুক্ত করেন। তৈরি করেন আরো আঁটসাঁট ভাতনিক। যুক্ত হয় নানান রকম নকশার এমব্রয়ডারি। ফ্যাশন যখন মুখ্য হয়ে ওঠে তখন পুরুত্বও কমে, দেখতে হয়ে ওঠে সাধারণ সোয়েটার সদৃশ।
বিংশ শতকের শেষদিকে অবসান ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের। তখন সোভিয়েত পরবর্তী রুশ ফ্যাশন ট্রেন্ড হিসেবে পশ্চিমা দুনিয়ায় নতুন করে সাড়া ফেলে ভাতনিক। ইউরোপের অনেক বিখ্যাত ফ্যাশন হাউজ এই জ্যাকেটকে নিজস্ব আঙ্গিকে ডিজাইন করে স্থানীয় ভোক্তাদের কাছে উপস্থাপন করে।
ভাতনিকের প্রাচীন ইতিহাস:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বহুল ব্যবহার শুরু হলেও ভাতনিক সৃষ্টির ইতিহাস কিন্তু আরো প্রাচীন।
এর উদ্ভব আসলে রাশিয়ায় নয়, বরং জার্মানিতে হার্টম্যান পরিবারের হাতে। এই পরিবারের কর্তা ও তার ছেলে ১৮৭০ সালে শিল্প পর্যায়ে কটন উল উৎপাদনের একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এ পদ্ধতিতে তৈরি পোশাকে তুলার আস্তরণই দিত পশমের মতো উষ্ণতা। এই আবিষ্কার বিশ্বের তুলা শিল্পে নতুন বিপ্লবের সূচনা করে। ফলে কটন উল ধীরে ধীরে ঘোড়ার চুল, ভেড়ার পশমের মতো প্রাণিজ ফাইবারের স্থান দখল করে নেয়।
রাশিয়ায় এটি প্রচলনের পেছনে দ্বিতীয় অনুঘটক ছিল জারের আমলে সেনাবাহিনীর সংস্কার ও আধুনিকায়ন। যেমন ১৮৭৭-৭৮ সনের রুশ-তুর্কি যুদ্ধ পর্যালোচনা করে সমরবিদেরা দেখেন, তখনকার প্রচলিত সামরিক উর্দি খুব একটা কাজের নয় এবং শীতে জমে যাওয়া থেকেও সেনাদের রক্ষা করতে পারে না। প্রচণ্ড শীতে ভুগে (হাইপোথার্মিয়ায়) ওই যুদ্ধে মারা যায় হাজারে হাজারে রুশ ও তুর্কি সেনা।
তাই ১৮৮২ সনে জার তৃতীয় অ্যালেক্সান্ডার সেনা ইউনিফর্মকে আরো সর্বময় ও ব্যবহারিক করে তোলার উদ্যোগ নেন। এসময় খরচ কমানোর প্রতিও মনোযোগ দেওয়া হয়। তখনই কটন উলের সমাধান সমরবিদদের মাথায় আসে। ১৮৮৫ সাল নাগাদ ককেশাস থেকে আসা রুশ বাহিনীর কসাক সেনারাই প্রথমে নরম ও উষ্ণ থাকার মতো তুলোট প্যাডযুক্ত ভাটনিক গায়ে চড়ায়।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে প্রাণরক্ষাকারী হিসেবে প্রমাণিত হয় ভাতনিক। সেলাই মেশিনে সহজে তৈরি করা সম্ভব হওয়ায় রুশ সেনাদের মধ্যে সহজে এটির বিতরণও সম্ভব হয়। প্রস্তুতের উপকরণ সস্তা হওয়ায় লাখ লাখ রুশ সেনাকে সহজেই দেওয়া গেছে জ্যাকেটটি।
কুখ্যাতির কারণ:
ভাতনিকের ব্যবহার সেনাবাহিনীর হাত ধরে শুরু হলেও, আজ তা অনেকটাই অতীতের বিষয়। এখন আরও আধুনিক তন্তুতে বুনিত জ্যাকেট, ওভারকোট পড়েন রুশরা। সেনাদের গায়েও তেমন দেখা যায় না ভাতনিক।
তবে পরবর্তী যুগে রাশিয়ায় ভাতনিক একটি গালিও হয়ে ওঠে, এমনই এর কুখ্যাতি।
যেমন সামাজিক মাধ্যমে যেসব রুশ নাগরিক জাতীয় ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতার পরিচয় দেন, তাদেরকে অন্যরা 'ভাতনিক' বলে গালি দেন। আবার যারা প্রচলিত অলীক কাহিনী ও অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যাকে সঠিক বলে মনে করেন তাদেরকেও ভাতনিক বলা হচ্ছে অহরহ। ২০১০ সালের পর থেকেই এ গালির প্রচলন বেশ বেড়েছে।
তাছাড়া, স্টালিনের শাসনামলে সাধারণ মানুষের দুর্দশা,স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা ও দমনপীড়নের ইতিহাসও জড়িত এই গালির সাথে।
আরো বিশদ ব্যাখ্যা করে প্রখ্যাত ভাষাবিদ ম্যাক্সিম ক্রোংগাউজ বলেন, "এই শব্দটি (ভাতনিক) সামাজিক ইঙ্গিতের সাথেও জড়িত। যেমন- এটি সমাজের অভিজাতবর্গ নয় বরং ছিল সাধারণের পরিধেয়। তাই ভাতনিক বলে অনেক সময় স্বল্প শিক্ষিত গোঁয়ার শ্রেণির মানুষকেও বোঝানো হয়, যাদের সহজেই বিভ্রান্ত করে নানান প্রপাগান্ডা।"
প্রতিবাদী রাশিয়ানরা রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন বা দূর্নীতি বোঝাতেও ভাতনিক প্রতীকীরুপে ব্যবহার করেন। কারো দুর্ভাগ্য বোঝাতেও বলা যায় সেই ইঙ্গিত দিয়ে, যেমন- 'তোমার কপালে স্রেফ ভাতনিকই জুটবে'।
তবে সে যাই হোক বহু পালাবদলের সাক্ষী- ভাতনিক। আর সে কারণেই হয়ে উঠেছে বিশ্বের একটি শক্তিধর দেশের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
- সূত্র: রাশিয়া বিয়ন্ড