যেভাবে ২৩,০০০ ফুট উচ্চতা থেকে পতন ঠেকিয়ে প্রাণে বাঁচেন এক পাইলট!
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের এক পাইলট মাঝ-আকাশে পড়ে যাচ্ছিলেন ককপিট থেকে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যান তিনি। তিন দশকেরও বেশি সময় পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে সেই অভাবনীয় ঘটনাটি।
১৯৯০ সালের জুন মাসে ফ্লাইটটি ছিল বার্মিংহাম থেকে মালাগা পর্যন্ত। প্লেন আকাশে উড্ডয়নের পর সবে ২৭ মিনিট পেরিয়েছে। অক্সফোর্ডশায়ার অতিক্রম করছে প্লেনটি। এমন সময় ঘটল এক ভয়ংকর দুর্ঘটনা। ভেঙে গেল ককপিটের ছয়টির মধ্যে দুটি জানালা।
বাইরের প্রচণ্ড বাতাসের তোড়ে নিজের আসন থেকে ছিটকে পড়লেন ক্যাপটেন টিম ল্যাঙ্কাস্টার। মাটি থেকে ২৩,০০০ ফুট উপরে, জানালা দিয়ে বেকায়দা অবস্থায় ঝুলতে থাকলেন তিনি। পড়ে গেলেই মৃত্যু নিশ্চিত!
এদিকে মাঝ-আকাশের ঝড়ো বাতাসে কব্জা থেকে আলগা হয়ে গেল ককপিটের দরজাটাও। ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট নাইজেল অগডেন তো আরেকটু হলেই ভূপাতিত হচ্ছিলেন।
তবে কোনোরকমে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করলেন তিনি। ককপিটে ছুটে গিয়ে ধরে ফেললেন পাইলটের পা। আরেকটু দেরি করলে হয়তো পাইলটকে আর বাঁচানো যেত না।
সিডনি মর্নিং হেরাল্ডকে অগডেন সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন, "আমি দ্রুত পিছন ফেরে দেখতে পেলাম ফ্রন্ট উইন্ডস্ক্রিনটা উধাও হয়ে গেছে। আর পাইলট টিম পড়ে যাচ্ছেন ওই জানালা দিয়ে। সিটবেল্ট ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছেন তিনি। আমি শুধু তার পা দুটোই দেখতে পাচ্ছিলাম।
"আমি কন্ট্রোল কলামের উপর দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে তার কোমর জড়িয়ে ধরলাম, যেন তিনি পুরোপুরি প্লেন থেকে পড়ে না যান। তার শার্ট পেছন থেকে খুলে এসেছিল, এবং শরীরটা ঝুঁকে ছিল এয়ারক্র্যাফটের উপরের দিকে।"
মাঝ-আকাশে ৬৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে ছুটন্ত প্লেনের উপর ওরকম অবস্থায় পাইলটকে ধরে রাখতে গিয়ে অগডেনের নিজেরও পিছলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। কিন্তু ভাগ্যের জোরে, ওই সময়ে জন হেওয়ার্ড নামে দ্বিতীয় একজন কেবিন ক্রু মেম্বার ককপিটে ছুটে এসে তার বেল্ট ধরে ফেলেন।
অগডেন আরও জানান, "আমি তখনও টিমকে ধরে ছিলাম, কিন্তু আমার হাত ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। এরপর একসময় তিনি পিছলে পড়তে শুরু করেন। আমি ভেবেছিলাম আমরা এবার তাকে হারাতে চলেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি জানালাকে আঁকড়ে ধরে থাকেন ইউ-শেপে।
"তার মুখ জানালার সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছিল, আর রক্ত ঝরছিল তার নাক থেকে, মাথার পাশ দিয়ে। হাতগুলো খুব জোরে জোরে নড়ছিল। মনে হচ্ছিল, সেগুলো যেন ৬ ফুট করে লম্বা। সবচেয়ে গা-শিউরে ওঠা ব্যাপার হলো, বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। যতদিন বেঁচে থাকব, ওই দৃষ্টির কথা ভুলতে পারব না।"
ইতোমধ্যে কো-পাইলট অ্যালেস্টার অ্যাচিনসন এসে কন্ট্রোলের দায়িত্ব নেন, এবং সাইমন নামের আরেকজন ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট এসে তৃতীয় চেয়ারে বসে উদ্ধারকারীদের শেকলটিকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করেন।
সানডে টাইমসকে দেওয়া আরেক সাক্ষাৎকারে অগডেন জানান, "আমার শুধু এটুকু মনে আছে, আমি কো-পাইলট অ্যালেস্টার অ্যাচিনসনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আর তিনি প্লেনটিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং রেডিওতে 'মে-ডে! মে-ডে!' বলে চিৎকার করছিলেন!
"ঈশ্বরই জানেন কীভাবে সম্ভব হলো, কিন্তু এই এতসবের মাঝেও অ্যালেস্টার ঠিকই প্লেনটিকে নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছিলেন। নিঃসন্দেহে তার উপর অমানুষিক চাপ ছিল, সকলের জীবন ছিল তার হাতে। কিন্তু তিনি একদম পারফেক্টলি প্লেনটিকে মাটিতে এমার্জেন্সি ল্যান্ডিং করাতে সক্ষম হন।"
প্লেনটি অবতরণ করেছিল সাউদাম্পটন এয়ারপোর্টে। সেখানে পাইলট, ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট, কেবিন ক্রুসহ সাধারণ যাত্রীদের জরুরী চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া পাইলট বেশ কিছু গুরুতর চোট ও ফ্রস্টবাইটের শিকার হলেও, প্রাণে বেঁচে যান ঠিকই।
অগডেন পরবর্তীতে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ছেড়ে চলে যান। যোগ দেন স্যালভেশন আর্মিতে। কিন্তু ক্যাপটেন ল্যাঙ্কাস্টার এই ঘটনার পরও ফের ওড়েন প্লেন নিয়ে। চালিয়ে যান পাইলটের কাজ।
এয়ার অ্যাক্সিডেন্টস ইনভেস্টিগেশন ব্রাঞ্চ এই ঘটনার পর একটি তদন্ত করেছিল। সেই তদন্তে বেরিয়ে আসে, উইন্ডস্ক্রিন লাগানোর জন্য একজন মিস্ত্রি ভুল বোল্ট লাগিয়েছিলেন। প্লেন আকাশে ওড়ার ২৭ ঘণ্টা আগে ভুলভাবে লাগানো উইন্ডস্ক্রিন থেকেই দুর্ঘটনার সূত্রপাত।
এই পুরো ঘটনাটিকে রিক্রিয়েট করে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে প্রচারের জন্য নির্মাণ করা হয় 'এয়ার ক্র্যাশ ইনভেস্টিগেশন - ব্লো আউট' নামের একটি ডকুমেন্টারি। ওই ডকুমেন্টারির কয়েকটি দৃশ্যই সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ফলে লোকে নতুন করে কথা বলতে শুরু করে প্রায় ৩২ বছর আগে ঘটা সেই শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনাটির ব্যাপারে।
- সূত্র: দ্য সান