হত্যা, টিনটিন, ক্যালেন্ডারের ভুল আর ভালোবাসার দিন
সাধু ভ্যালেন্টাইনকে হত্যা করা হলো।
কে এই সাধু? ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীর এক পাদ্রী ও চিকিৎসক ছিলেন তিনি। রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। কেন? কেউ বলে তার জনপ্রিয়তায় হিংসে করে, আবার কেউ বলে তিনি নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে সৈন্যদের বিয়ে দিতেন। রোমান সাম্রাজ্যে সেসময় সৈন্যদের বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। বিদ্রোহী ভ্যালেন্টাইন এই কুপ্রথা মানেন নি।
এর বহু বছর পরে তার বলিদানকে স্মরণীয় করে রাখতে চার্চ নির্দেশ দিল এই দিনকে যথাবিহিত সম্মানের সাথে পালন করতে হবে। কিন্তু কোন দিন? আবার গোল বাধলো। অর্থডক্স চার্চ বলল ৬ জুলাই, আর ক্রিস্টান চার্চ ২৩ ফেব্রুয়ারি। গোটা ব্যাপারটা একেবারেই ধর্মীয়, তাই এতে সাধারণ মানুষের মাথা ঘামানোর কথাই না। তারা ঘামাতও না।
কিন্তু মুশকিলটা শুরু করলেন জিওফ্রে চসার। হ্যাঁ, সেই ভদ্রলোক, যিনি ক্যান্টারবেরী টেলস লিখে বিখ্যাত। ১৩৮২ সালে তার Parlement of Foules এ তিনি লিখলেন-
"For this was on seynt Volantynys day
Whan euery bryd comyth there to chese his make"
মানে, এই ভ্যালেন্টাইন ডে'তে নাকি প্রতিটি পাখি তার সঙ্গী বেছে নেয়। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ইংল্যান্ডে বসন্ত শুরু হতো। তাই চিন্তাটা খুব একটা কষ্টকল্পিতও ছিল না। ব্যাস! আর যায় কোথায়। শুধুমাত্র ধর্মের ঘেরাটোপে আর আটকে রইল না দিনটি। গোটা ইংল্যান্ডজুড়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি হয়ে উঠল 'ভালোবাসার দিন।'
১৫৮২ সালে পুরোনো জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে ত্যাগ করে নতুন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গৃহীত হয় ইংল্যান্ডে। ফলে আগেকার সব তারিখ গেল উল্টে-পাল্টে। ২৩ ফেব্রুয়ারি গিয়ে পড়ল ১৪ ফেব্রুয়ারিতে। আর সেই থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারিতেই অকাল 'বসন্ত।'
তবে এই দিন শুধু ভালোবাসার দিনই না। এইদিনেই ঘটেছিল পৃথিবীর জঘন্যতম এক হত্যাকাণ্ড। স্থান আমেরিকা। কাল ১৯২৯। আমেরিকার অপরাধ জগতে আল কাপোন সবে মাথা চাড়া দিচ্ছেন। একে আমরা সব্বাই চিনি। ইনিই আমেরিকায় টিনটিনের অভিযানের হেভি ওয়েট ভিলেন। আমেরিকায় মদের উপর যখন নিষেধাজ্ঞা চলছিল, তখনই কাপোন মহানন্দে মদের চোরাচালান করে ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন। যথারীতি বিরোধ বাধল অন্য দলের সাথে। শিকাগোতে তার দলের লোকেরা বিরোধী আইরিশ আমেরিকান গ্যাং এর সাতজনকে দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে টমি গানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল।
এরপরেই কাপোন হয়ে ওঠেন শিকাগোর অপরাধ জগতের মুকুটহীন সম্রাট। ঘটনাটা Saint Valentine's Day Massacre নামে কুখ্যাত। ঘটেছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি।
যাক গে যাক! আবার সে এসেছে ফিরিয়া...বাঙালির নবীনতম উৎসব ভ্যালেন্টাইন ডে। ভালোবাসার দিন হত্যার কথা বলে নষ্ট না করে বরং ভালবাসা নিয়ে দু এক কথা বলা যাক।
ভাবছিলাম বাঙালি ঠিক কবে থেকে ভালবাসতে শিখল? আর তা খুঁজতে গিয়েই যা দেখলুম, তাতে একগাল মাছি।
প্রাচীন যুগ তো বাদই দিন মশাই, এমনকি মধ্য যুগেও বাঙালি ভালোবাসত না। খেয়াল করবেন এতজন বৈষ্ণব কবি এত এত লাইন প্রেমের কবিতা লিখে মন আর চোখ ভরালেন, তাদের একজনও একটি লাইনেও 'ভালোবাসা' শব্দটা লিখলেন না!!!
তবে তারা কি লিখতেন? লিখতেন মূলতঃ প্রেম, প্রীতি আর তার চেয়েও বেশি 'পিরীতি'। চণ্ডীদাস লিখেছেন,
"কালিয়া প্রেমের মধু" কিংবা
" আমি তো দুঃখিনী, কুলকলঙ্কিনী/ হইনু করিয়া প্রীত" অথবা
" আপন সুখেতে করে যে পিরীতি/ তাহারে বাসিব পর"।
শেষ বাক্যটা মনে রাখবেন পিরীতির সঙ্গে 'বাসিব' শব্দটাও আছে। ওটা আমাদের পরে কাজে লাগবে।
তাহলে ঠিক কবে ভালোবাসা এই পিরীতি- কে হটিয়ে দারুণভাবে আমাদের মনের কোমল পর্দায় রিনরিনে ধ্বনি তুলল? একই সঙ্গে প্রীতি নেহাত শুভেচ্ছার বড় বোন হয়ে আর পিরীতি নাম বদলে পিরিত হয়ে বেশ একটা অশ্লীল অশ্লীল গন্ধ বয়ে নিয়ে এল? (অবশ্য ইদানীং আবার পিরীতি গানে জায়গা পাচ্ছে, প্রেম পিরিতে হাবুডুবু পরাণ আমার যায়/ বুকটা করে সামথিং সামথিং টেল মি উপায়... ইত্যাদি। মানে পিরিতের দিন ফিরছে বোধহয়)...পাশাপাশি প্রেম বেশ গম্ভীর। সিরিয়াস সিরিয়াস ব্যাপার। 'হাবুদা আর পেঁচিদি পিরিত করে', 'হাবুদা আর পেঁচিদি ভালোবাসে' আর 'হাবুদা আর পেঁচিদি প্রেম করে'... বলে দেখুন লাস্টটা নিজের কানেই কেমন কেমন ঠেকবে। হাবু আর পেঁচি নাম থেকে গোটা স্পটলাইট প্রেমে গিয়ে পড়বে।
আমাদের হোস্টেলে এক দাদা ছিল। মাঝে মাঝেই তার প্রেমিকার ফোন আসত। সে তীব্র থমথমে মুখে ফিসফিস করে কীসব যেন বলত। একবার এক নভিস "কি হয়েছে দাদা? সিরিয়াস কিছু?" বলাতে "দেখছিস না প্রেম কচ্ছি!" বলে মুখঝামটা খেয়েছিল।
সে যাই হোক। ভালোবাসা শব্দের কথা বলছিলাম। ভালোবাসার দুই অংশ- ভালো আর বাসা। এর মধ্যে ভালো শব্দটা আদৌ বাংলা না। হিন্দি বা মৈথিলী। স্বয়ং গুরুদেব লিখেছেন "ভালো' শব্দ ভদ্র শব্দজ, "বড়ো' বৃদ্ধ হইতে উৎপন্ন, "ছোটো' ক্ষুদ্র শব্দের অপভ্রংশ। মূল শব্দগুলোর শেষবর্ণ যুক্ত-- যুক্তবর্ণের অপভ্রংশে হসন্ত বর্ণ না হওয়ারই সম্ভাবনা।"
সোজা কথায় ভালো আছি মানে ভদ্রস্থ আছি। ঠিকঠাক আছি। চলে যাচ্ছে। আর "বাসা" শব্দ বাসনা- র উৎস। ১৩১৭ সালে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় খগেন্দ্রনাথ মিত্র লিখেছেন " বাসি শব্দটিও এখন বাসি হইয়া গিয়াছে। যদিও বিক্রমপুর অঞ্চলের সম্ভাষণে 'কেমন বাসতে আছেন?' শুনা গিয়া থাকে।" বাসা শব্দের মানে তাই ইচ্ছে, আকুতি।অর্থাৎ, ভালবাসা মানে ভদ্রস্থ থাকার বাসনা। যা মোটামুটি সবার থাকে।
হায় রে! এদিকে কালে কালে তার মানে এমন বদলেছে যে অভিধান খুললে ভালোবাসা মানে পাই "কোনও জিনিস বা ব্যক্তি-বিশেষকে প্রাণাধিক বলে জ্ঞান করা; মনোমত মনে করা; প্রীতি, স্নেহ বা শ্রদ্ধা করা...."
এখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু করব না; বাসা নিয়ে আর দু চারটে কথা বলবই। এই যে ফেবু জুড়ে কবিতাবাসা, আদরবাসা নিয়ে এত্ত এত্ত খিল্লী, কথাগুলো কি ভুল? ব্যাক টু চন্ডিদা থুড়ি চণ্ডীদাস...
" তোমরা মোরে ডাকিয়া শুধাও না প্রাণ আনচান বাসি"
" কে সাজাল হেন সাজে হেরি বাসি দুখ"
"পরাণ অধিক বাসে"
" কহিতে বাসি যে ভয়"
কেলো করেছে!! ভদ্রলোক করেছেন টা কি!! আনচান বেসেছেন, দুখ বেসেছেন। অধিক বেসেছেন, পর বেসেছেন আবার ভয়ও বেসেছেন? (যদিও ভালবাসেন নি)
ভাগ্যিস ফেসবুক ছিল না। তাহলে বিদ্যাপতি, বড়ু চণ্ডী আর জুনিয়ার নরহরি সরকার, বাসু ঘোষ, লোচন দাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস একেবারে ট্রোল করে করে মেরে দিত!!
যাই হোক। মরালটা কি খাড়াইল? "সব সত্যি। কবিতাবাসা সত্যি, গল্পবাসা সত্যি, প্রবন্ধবাসা...মে বি সত্যি, আদরবাসা সত্যি, মনের কথা ফোনের সেটে সত্যি।"
- লেখকের ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত