একটি কাঠের ব্যারেল ছিল ইতিহাসের প্রথম সামরিক সাবমেরিন!
পানির নিচ দিয়ে সবার অলক্ষ্যে সামনে এগিয়ে গিয়ে শত্রু জাহাজে আচমকা আক্রমণ করতে পারবে, এমন সাবমার্সিবল বোটের স্বপ্ন সেই প্রাচীনকাল থেকেই দেখে এসেছেন সামরিক নেতারা।
কিংবদন্তি রয়েছে, আলেকজান্ডার দি গ্রেট নাকি পানির নিচ থেকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ডুবো নৌকার একটি আদিম সংস্করণ নির্মাণেও হাত দিয়েছিলেন।
তাই আসলেই ঠিক কবে পানিতে নিমজ্জিত নৌকা তৈরির প্রচেষ্টা শুরু হয়, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে নিঃসন্দেহে, উইলিয়াম বোর্ন নামের এক ইংরেজ এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ব্যক্তিদের অন্যতম। সেই ১৫৭৮ সালেই তিনি ডুবো নৌকার ধারণাকে বাস্তবায়িত করতে উঠে পড়ে লাগেন।
তবে শেষ পর্যন্ত সে পরিকল্পনায় সফলতা আসে ১৬২০ সালে, কর্নেলিয়াস ড্রেবেল নামের এক ডাচম্যানের হাত ধরে। ড্রেবেল কাঠের এমন একটি সাবমেরিন তৈরি করেন, যেটি বৈঠা দিয়ে বাওয়া যেত, এবং বেশ কয়েক ঘণ্টা জলের তলায় থাকতে পারত।
নৌকার সঙ্গে টিউব সংযুক্ত কিছু ভাসমান বস্তু থাকত, যারা পানির পৃষ্ঠ থেকে নিচের ক্রুদের জন্য বাতাস বয়ে আনতে পারত।
ড্রেবেল তার নৌকার সামর্থ্য প্রমাণের জন্য এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেন। নৌকা নিয়ে টেমস নদীর পানির নিচে তিন ঘণ্টা অবস্থান করেন তিনি। সেদিন উৎসুক হাজার হাজার লন্ডনবাসী উপস্থিত হয়েছিল নদীর তীরে। শুরুতে মনে অবিশ্বাস খেলা করলেও, শেষমেশ তারা মানতে বাধ্য হয় যে ড্রেবেল সত্যিই এক অসাধ্য সাধন করেছেন।
সেদিন মজা দেখতে উপস্থিত জনতার ভিড়ে ছিলেন ডাচ কবি ও সুরকার কনস্ট্যান্টিন হয়গেনস। পরবর্তীতে তিনি তার লেখায় বলেন, এই "সাহসী উদ্ভাবনটিকে" যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা এবং প্রতিপক্ষের আপাত নিরাপদে অবস্থানরত জাহাজকে অতর্কিতে আক্রমণ করে ডুবিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল।
হয়গেনসের মতো আরও অনেকেই সাবমেরিনের সামরিক সম্ভাবনার বিষয়টি আঁচ করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে প্রথম মিলিটারি সাবমেরিনটি তৈরি হয় আরও একশো বছর পর।
১৭১৮ সালে ইয়েফিম নিকোনভ নামের এক রাশিয়ান কাঠমিস্ত্রি পিটার দ্য গ্রেটকে চিঠি লিখে জানান, তিনি নাকি এমন একটি "গোপন নৌযান" তৈরি করতে পারবেন, যেটি পানির নিচ দিয়ে চলাচল করে কামান দিয়ে শত্রুদের সব জাহাজকে ধ্বংস করে দিতে পারবে।
অদ্ভুত ধরনের সেই চিঠি পেয়ে যারপরনাই অবাক হন জার। আগ্রহও জাগে তার মনে। তিনি নিকোনভকে সেইন্ট-পিটার্সবার্গে আমন্ত্রণ জানান, এবং নির্দেশ দেন এমন একটি নৌযান নির্মাণের কাজ শুরু করে দিতে।
১৭২১ সালে মডেলটি নির্মাণের কাজ শেষ করেন নিকোনভ। স্বয়ং পিটারের উপস্থিতিতেই তিনি নৌযানটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করেন। পিটার বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন দৃশ্যমান ফলাফলে। তাই নিকোনভকে নির্দেশ দেন এবার একটি পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের নৌযান বানাতে।
নিকোনভের সাবমেরিনটি বানানো হয় কাঠ দিয়ে। আকৃতি ছিল ব্যারেলের মতো। 'ফায়ার টিউবস' নামক এক ধরনের আগুন-ছোড়ার অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত ছিল সেটি।
নিকোনভের বর্ণনা ছিল এমন—সাবমেরিনটি শত্রুর জাহাজের দিকে ধেয়ে যাবে, পানির উপর দিয়ে 'টিউব' উঁচিয়ে ধরবে, এবং উড়িয়ে দেবে শত্রুর জাহাজকে। এর পাশাপাশি তিনি অ্যাকুয়ানটদের (পানির নিচে সাঁতরায় যারা) জন্য এয়ারলকেরও ডিজাইন করেন, যেন তারা সাবমেরিন থেকে বেরিয়ে এসে শত্রুর জাহাজের তলাটা ধ্বংস করে দিতে পারে।
১৭২৪ সালের শরতে সাবমেরিনটির প্রথম ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয়। সেবার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। নিকোনভের যাবতীয় পরিকল্পনা মাঠে মারা যায়। সাবমেরিনটি ডুবে যায়, এবং তার নিজের তলাই যায় ভেঙে। নৌকায় নিকোনভ ছাড়াও আরও চারজন মাঝি ছিলেন। দৈববলে তারা সেবার প্রাণে বাঁচেন।
তবে পিটার বরাবরের মতোই ইতিবাচক ছিলেন নিকোনভের বুদ্ধির ব্যাপারে। তিনি নিকোনভকে উৎসাহ দেন ডিজাইনে আরও উন্নতি করতে। কিন্তু নিকোনভ একের পর এক ব্যর্থতাই উপহার দিতে থাকেন। বিশেষত জার পিটারের মৃত্যুর পর তার মাথার উপর থেকে স্নেহের ছায়া সরে যায়। তাই আরও বেসামাল অবস্থা হয় তার। ১৭২৫ সালের বসন্তে দ্বিতীয় ট্রায়াল, এবং ১৭২৭ সালে তৃতীয় ট্রায়ালে কোনো ফলই মেলে না।
এক পর্যায়ে ধৈর্যচ্যুতি হয় অ্যাডমিরালটি বোর্ড অব দ্য ইম্পেরিয়াল রাশিয়ান নেভির। পাবলিক ফান্ডের অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয় নিকোনভের বিরুদ্ধে। আগের সব সম্মান কেড়ে নিয়ে তাকে নামিয়ে দেওয়া হয় একজন সাধারণ কাঠমিস্ত্রির কাতারে। ভোলগা নদীর তীরে একটি শিপইয়ার্ডে কাজ করতে শুরু করেন তিনি।
মিলিটারি সাবমেরিনের প্রথম সফল ব্যবহার ঘটে ১৭৭৫ সালে, মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধে। সেবার টার্টল নামের একটি সাবমেরিনের ডিজাইন করেন আমেরিকান উদ্ভাবক ডেভিড বুশনেল। এটি ছিল হাতে চালিত ডিম্বাকৃতির একটি ডিভাইস, যা কেবল একজন মানুষকেই বহন করতে পারত। তবে স্বাধীনভাবে পানির নিচে বিচরণ করতে পারা প্রথম সাবমেরিন ছিল এটিই।
টার্টল পানির নিচে নামত নৌযানটির তলার ট্যাংকে পানি প্রবেশ করতে দিয়ে, আর উপরে উঠত হ্যান্ডপাম্পের সাহায্যে পানি বের করার মাধ্যমে। হাতে ঘোরানো প্রপেলার দিয়ে সাবমেরিনটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার গতিতে উল্লম্ব বা অনুভূমিকভাবে চলাচল করত। ৩০ মিনিট কাজ চালানোর মতো যথেষ্ট পরিমাণ বাতাস মজুদ রাখা যেত এই নৌযানে।
মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সার্জেন্ট এজরা লি'র পরিচালনায় টার্টল একটি এইচএমএস ঈগল নামের একটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ আক্রমণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আক্রমণ বিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিজের কাজ শুরুর আগেই ধরা পড়ে যান লি। তাই তাকে সাবমেরিন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়।
অবশ্য সাবমেরিনটির ওই ব্যর্থ অপারেশন সম্পর্কে যত রেকর্ড রয়েছে, তার সবই আমেরিকান। ব্রিটিশদের তরফ থেকে যুদ্ধকালে কোনো সাবমেরিনের ব্যাপারে রেকর্ড রাখা হয়নি। তাই অনেক ইতিহাসবিদই এই গল্পের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকেই মনে করেন, টার্টল নিয়ে এই গোটা কাহিনিটাই ছিল সাজানো ও বানোয়াট। এটি ছিল নিছকই আমেরিকানদের মানসিকভাবে চাঙ্গা করার স্বার্থ্যে প্রচারিত একটি প্রোপাগান্ডা।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জাদুঘরে টার্টলের রেপ্লিকা রাখা আছে। এমনকি ইংল্যান্ডের গোসপোর্টে রয়্যাল নেভি সাবমেরিন মিউজিয়ামেও রয়েছে টার্টলের রেপ্লিকা।
- সূত্র: অ্যামিউজিং প্ল্যানেট