দিনাজপুরের স্কুল শিক্ষকের মৌমাছি চাষ কীভাবে অন্য তরুণদের আকৃষ্ট করলো
সুগন্ধি ধান ও লিচুর জেলা হিসেবে পরিচিতি রয়েছে উত্তরের জেলা দিনাজপুরের। গত বছরও এই জেলায় ২ হাজার ২৫ কোটি টাকার সুগন্ধি জাতের ধান উৎপাদিত হয়েছে। আর লিচুর উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪শ' কোটি টাকার।
মাটির উর্বরতার কারণে বছরের বেশিরভাগ সময়ই এই জেলায় উৎপাদিত হয় বিভিন্ন ধরনের শস্য ও ফল। ফলে এখান থেকে বিপুল পরিমাণে মধু আহোরণের সম্ভাবনা দেখছেন মৌচাষী ও গবেষকরা। দিনাজপুরে কেবল সরিষা ও লিচুর মুকুল থেকে যে পরিমাণে মধু উৎপাদন করা যাবে, খুচরা বাজারে তার মূল্য প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে এই জেলা মধু উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য দেখাতে পারবে। আর এই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন দিনাজপুরের তরুণ মোসাদ্দেক হোসেন। ইতোমধ্যেই তিনি প্রায় দেড় শতাধিক তরুণকে এ বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। নিজের উপার্জনের ১০ শতাংশ অর্থ দিয়ে প্রশিক্ষণ দেন তরুণদের, নিজ খরচে তাদেরকে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার মাঠ পরিদর্শন ও মধু আহোরণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করিয়েছেন।
কে এই মোসাদ্দেক
দিনাজপুর সদর উপজেলা এলাকার তরুণ মোসাদ্দেকের জন্ম ১৯৯৪ সালে। ২০১৮ সালে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকত্তোর সম্পন্ন করে ২০১৯ সালে দিনাজপুর সারদেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরই মধ্যে যুক্ত হয়ে পড়েন মৌপালন কার্যক্রমে। করোনার সময়কালে বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে পড়লে পুরোপুরিভাবেই মৌপালন কার্যক্রমে মনোনিবেশ করেন তিনি। এক পর্যায়ে তিনি লক্ষ্য করলেন, বিপুল পরিমাণ অর্থের মধু নষ্ট হয়ে যায় কেবল আহোরণের অভাবে। সেইসঙ্গে তিনি বুঝলেন, মৌপালনে তরুণদেরকে প্রশিক্ষিত করতে পারলে তাদের আর কর্মসংস্থান নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
এই চিন্তা থেকেই তরুনদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন, প্রশিক্ষনও দেন হাতে-কলমে। গঠন করেন 'আলোর পথে জাগো যুব' নামের একটি সংগঠন। এই সংগঠনের কাজই হলো তরুণদেরকে স্বাবলম্বী করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া। ইতোমধ্যেই তিনি প্রায় দেড় শতাধিক তরুণকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন। সাম্প্রতিক মৌ খামার স্থাপন করে দিনাজপুরের তরুণদের কর্মসংস্থানে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দিনাজপুরকে মধুর জেলায় রূপান্তরের স্বপ্ন দেখছেন ও দেখাচ্ছেন। উদ্ভাবনী কার্যক্রমে তার সফলতা উৎসাহিত করছে শিক্ষার্থী ও যুব সমাজকে। কৃষি জমিতে পোকা দমনে উদ্ভাবন করেছেন পোকা দমনযন্ত্র। ৩৬ তম জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহে দেশের সেরা প্রকল্প হিসেবে প্রথম স্থান অর্জন করে তার এই উদ্ভাবন।
কী পরিমাণ মধু উৎপাদন হবে দিনাজপুরে
দিনাজপুরে সবচেয়ে বেশি মধু আহোরন করা হয় লিচুর মুকুল থেকে। মৌখামারীদের হিসাব মতে, প্রতি বছরই জেলার লিচু বাগানগুলো থেকে প্রায় ২০ থেকে ২১ কোটি টাকার মধু আহোরণ হয়। তবে খামারী স্বল্পতার কারণে এই মধু আহোরণ সম্ভাবনার চেয়ে মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতি বছরে এই জেলা থেকে কমপক্ষে ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকার মধু আহোরণ করা যেতে পারে। মধু আহোরণের আরেকটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে সরিষার ফুল থেকে। খামারীদের হিসাব বলছে, জেলায় যে পরিমাণ সরিষার আবাদ হয়, তা থেকে কমপক্ষে ২১০ কোটি টাকার মধু আহোরণ করা সম্ভব। অর্থাৎ, বছরে কেবল লিচু ও সরিষার ফুল থেকেই মধু আহোরণ হতে পারে ৪০০ কোটি টাকার। আর এই হিসাবের সঙ্গে পাইকারি ও খুচরা হিসাব যোগ করলে দাঁড়ায় কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকা।
মৌ খামারী ও গবেষকরা যা বলছেন
দিনাজপুরে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে সরিষার আবাদ। চলতি বছরে এই জেলায় সরিষার আবাদ হয়েছে ১৬ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে। আর এই সরিষা ক্ষেতেই প্রচুর পরিমাণে মধু উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে আবাদের একটি বাড়তি লাভ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এই মধু। মৌখামারীদের দেওয়া তথ্যমতে, এক একর জমির সরিষা ক্ষেত থেকে কমপক্ষে ৩৫০ কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। সেই হিসেবে জেলায় আবাদ হওয়া ১৬ হাজার ১০০ হেক্টর বা ৩৯ হাজার ৭৮৪ একর জমির সরিষা ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহ করা যাবে ১ কোটি ৩৯ লাখ ২৪ হাজার ৪০০ কেজি। পাইকারি বাজারে যার মূল্য কমপক্ষে ২১০ কোটি টাকা। আর খুচরা বাজারে এই মূল্য দ্বিগুণের বেশি।
১৬ জেলা নিয়ে গঠিত মৌখামারীদের সংগঠন 'উত্তরবঙ্গ মৌচাষী সমিতি'র সহ-সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, "দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে ৩৫০ থেকে ৩৭৫ টি খামার মধু উৎপাদন করে। এসব খামার মূলত লিচুর সময়ই মধু সংগ্রহ করে।"
এর মধ্যে দিনাজপুরে ৩০০ থেকে ৩২৫টি খামার। পাশাপাশি সাতক্ষীরা, নড়াইল ও যশোরেরও ২০ থেকে ২৫টি খামার রয়েছে। প্রত্যেক খামারে সর্বনিম্ন ২ টন করে মধু সংগ্রহ হলে শুধু দিনাজপুর থেকেই ৭০০ টন মধু সংগ্রহ হয়। আর ঠাকুরগাঁওয়ে হয় ১০০ টন মধু। আর প্রতি টন মধুর ন্যূনতম দাম ৩ লাখ টাকা।
দিনাজপুরে ব্যাপকহারে সরিষার চাষ হওয়ায় এখান থেকেও মধু আহোরণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এক একর জমির সরিষা ক্ষেতে ৯ মন মধু সংগ্রহ করা যায়। প্রথমে কৃষকরা সরিষা ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহ বাধা দিলেও এখন তারা বুঝতে পেরেছেন, মৌমাছির মাধ্যমেই ফুলে পরাগায়ন ঘটে। ফলে ফসল উৎপাদন হয় বেশি।
মধু উৎপাদনে আরেকটি সমস্যা হল, উত্তরবঙ্গে কোনো মধুর প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট নেই। যদি প্ল্যান্ট থাকতো তাহলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে পর্যন্ত মধু রপ্তানি করা সম্ভব হতো বলে মনে করেন গবেষকরা। উত্তরঙ্গের কৃষকরা জানান, বর্তমানে দেশ থেকে বিভিন্ন কোম্পানি মধু রপ্তানি করলেও এতে তাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। এসব কোম্পানির সিন্ডিকেটের কারণে উপযুক্ত দামও তারা পাচ্ছেন না।
মধু ও মৌমাছি নিয়ে গবেষণা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থায় (ইউএস এইড) কর্মরত ড. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেন, বর্তমানে মধু সংগ্রহের জন্য এপিস মেলিফেরা নামের মৌমাছি ব্যবহৃত হয়। মাত্র ৫ দিনের প্রশিক্ষণ এবং খামারে গিয়ে হাতে-কলমে একটু প্রশিক্ষণ নিলেই তরুণদের আয় বাড়বে ও উন্নতি হবে।
"আমরা চেষ্টা করছি তরুণদেরকে প্রশিক্ষিত করতে এবং আরো স্বল্পসময় ও মূল্যে কীভাবে মধুর উৎপাদন করা যায় তা নিয়ে কাজ করতে। দুই-তিন প্রজাতির মৌমাছির মিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন প্রজাতির উদ্ভাবন হওয়ার দিকে আমরা জোর দিচ্ছি", তিনি আরও বলেন।
সেইসঙ্গে তিনি জানান, মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়নের ফলে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ফলন বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা পেলে এই মধু অন্যান্য শিল্পের মত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে, মোসাদ্দেক হোসেনের স্বপ্ন দিনাজপুর জেলাকে মধুর জেলায় রূপান্তর করা। নিজের স্বপ্ন পূরণে তাই সমাজের তরুণদের নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছেন তিনি।
মোসাদ্দেক জানান, চলতি বছরে তার মধু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৩ থেকে ৪ টন। যার বাজার মূল্য খুচরা বাজারে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। আর পাইকারি বাজারে এর মূল্য ৫ লাখ টাকার কম না।
তিনি বলেন, "দিনাজপুরে প্রচুর লিচুর বাগান রয়েছে, সরিষার আবাদও হয়। এই জেলাকে মধুর জেলা হিসেবে রুপান্তর করা যাবে সহজেই।তবে, এর জন্য প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা, প্রয়োজন তরুণদেরকে প্রশিক্ষিত করতে প্রশিক্ষণ। তরুণদেরকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা গেলে এবং লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়া গেলে এসব তরুণরা সাবলম্বী হতে পারবে।"
দিনাজপুর পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং করা ইফাদুজ্জামান কাজ করছেন মৌমাছি নিয়ে। তিনি বলেন, "বর্তমানে চাকরির বাজার মন্দা। আমার মত অনেকেই রয়েছেন যারা চাকরির পিছনে ছোটাছুটি করছেন। এক ধরনের অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা চলছে। হয়তো চাকরি করে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা উপার্জন করা যাবে। কিন্তু আমি চেয়েছি নিজে কিছু করতে। এরপর থেকেই মোসাদ্দেক ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি।"
এরপরেই প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করেন ইফাদুজ্জামান। বর্তমানে তার ৪টি মৌবাক্স রয়েছে। সেগুলো থেকে প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা করে আয় করেন তিনি।
"আমার ইচ্ছা এক বছরের মধ্যেই এই মৌবাক্স ৮ থেকে ১০টি করা। যাতে করে আমার উপার্জন দ্বিগুণ হয়", তিনি আরও করেন।
ইফাদুজ্জামানের মতো রাকিব হাসান রিফাতও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন মৌপালনে। গত ৪ মাস ধরে মৌমাছি নিয়ে কাজ করছেন তিনি। রিফাত জানান, যে আয় হয় তাতে নিজের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে বাড়িতেও টাকা পাঠান তিনি।
মৌপালন ও মধু উৎপাদন কার্যক্রমে এভাবেই নিজের এলাকায় তরুণদের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন মোসাদ্দেক। তার সহযোগিতায় অনেক বেকার চাকরির সন্ধান বাদ দিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।