করোনা আর গ্রাহকদের অনাস্থায় ধুঁকছে দেশের বীমা খাত
অন্যান্য অনেক খাতের মতো কোভিড-১৯ এর প্রভাব পড়েছে দেশের বীমা কোম্পানিগুলোর ওপরও। তবে এ সংকট শুরু হয়েছিল মহামারির আগেই, বীমাকারীদের অনিয়মের জন্য গ্রাহকদের আস্থার অভাবে।
দেশের বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তথ্যমতে, ২০১৮ সালে সারাদেশে ১৭ লাখ ৭৫ হাজার ৩১৮ জন নতুন পলিসি কেনেন। ২০১৯ সালের নতুন গ্রাহকসংখ্যা ছিলো ১৬ লাখ ৭৩ হাজার ৪৬৫ জন।২০২০ সালে এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৪ লাখ হাজার ৬২১। ২০২১ সালে এ সংখ্যা কিছু বেড়ে হয়েছে ১৪ লাখ ৯৫ হাজার ৬২১।
চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার গৃহিনী সুলতানা আক্তার। ২০১৯ সালে ভবিষ্যতের আর্থিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে একটি বীমা কোম্পানি থেকে জীবন বীমার দশ বছর মেয়াদী পলিসি নেন । কিন্তু ২০২০ সালে প্রথম দফা লকডাউন চলাকালে চাকরি হারান তার স্বামী মাজেদুল আনোয়ার। এ কারণে সে বছরের জুলাই মাস থেকে তিনি আর বীমার কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন নি। এ বছর তার পলিসির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
সুলতানা বলেন, "ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বীমা করেছিলাম। কিন্তু স্বামী চাকরি হারানোর পর সেটা পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এখন কোনো মতে খেয়ে পরে বেঁচে আছি। এখন সঞ্চয়ের কথা আমরা আর চিন্তাও করতে পারছিনা।"
শুধু সুলতানা নন, গত চার বছরে বীমা পলিসি তামাদী হয়েছে এমন গ্রাহকের সংখ্যা ৫২.৫৫ লাখ।
গ্রাহকদের অভিযোগ, বীমা করার সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ম্যাচুরিটি বেনিফিট দেওয়া হয় না তাদের।
সাংবাদিক ইলিয়াস খন্দকার জানান, একটি বীমা কোম্পানিতে বিভিন্ন কিস্তিতে পাঁচ বছরে ৬০ হাজার টাকার বেশি জমা দেন তিনি। পলিসিটি ম্যাচিউর হওয়ার পর তাকে ৮০হাজার টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বীমা কর্তৃপক্ষ তাকে উপযুক্ত কোনো কারণ দেখাতে পারেনি।
গ্রাহকদের আরও অভিযোগ, বীমা কোম্পানিগুলো সময় মতো গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেয় না।
প্রগতি লাইফ ইনসুরেন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জালালুল আজীম বলেন, "বীমা খাতে বড় সমস্যা হলো ইমেজ সংকট। যদিও আইডিআরএ, বিআইএসহ সংশ্লিষ্টরা এটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, কিন্তু গেলো বছর দেশের শীর্ষস্থানীয় দু'টি কোম্পানি ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ও ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ঘটনা একে আরো কঠিন করে তুলেছে।"
উল্লিখিত দুটি কোম্পানি গত বছর তাদের পলিসি হোল্ডারদের কোনো ডিভিডেন্ড দেয়নি।
রিলায়েন্স ইনসুরেন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. খালেদ মামুন বলেন,, "২০২০ ও ২০২১ সালে একটাই চ্যালেঞ্জ ছিল-করোনা। শুরুর দিকে সবার ব্যবসায়ই উত্থাপন-পতন ছিল। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা গেছে মোটর ইনসুরেন্স ব্যবসায়। এছাড়াও অনেক কোম্পানি কমপ্লায়েন্ট ছিল না, যার প্রভাবও ছিল ব্যবসার ওপর। তবে আইডিআরএ'র নির্দেশনা সঠিকভাবে মানলে এ সমস্যা হতো না।"
করোনার আঘাত
নতুন পলিসির সংখ্যা কমে যাওয়ায় ২০২১ সালের বিগত বছরের তুলনায় তামাদি পলিসির সংখ্যাও কমেছে। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৬৪৯ জন। ২০২১ সালে এই সংখ্যা নেমে দাঁড়ায় ৯ লাখ ৪৮ হাজার ৪০৩ এ।
অন্যদিকে করোনা মহামারির কারণে প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার পরিমাণও কমেছে। জীবন বীমার ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে পলিসি জমা দেওয়ার পরিমাণ ছিল ৮,৯৯২ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ৯,৫৮৯ কোটি টাকা। ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৯,৫০১ কোটি টাকা।
আইডিআরএর তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে ৩৩টি জীবন বীমা কোম্পানি রয়েছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রায় প্রত্যেকটি কম্পানির প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার রেট কমেছে।
শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি মেটলাইফ ইনসুরেন্সের ২০১৯ সালে নতুন পলিসির সংখ্যা ছিল দুই লাখ পাঁচ হাজার ৫৯৩। ২০২১ সালে তা কমে দাঁড়ায় এক লাখ ৪২২ হাজার ৫০০ তে। আরেক কোম্পানি বায়রা লাইফ ইনসুরেন্সের ২০১৯ সালে নতুন ইস্যুকৃত পলিসি ছিল দুই হাজার ১৬০। ২০২১ সালে নেমে এই সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র্র ২৫৯ এ।
বাংলাদেশ জীবন বীমা করপোরেশনের ২০১৯ সালে নতুন ইস্যুকৃত পলিসির সংখ্যা ছিল ৪১ হাজার ৯৭২। ২০২১ সালে এই সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ২১১ জনে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক সুলতান আহমদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আধুনিক বিশ্বে দিনদিন বীমার গুরুত্ব বাড়লেও আমাদের দেশে ঋণাত্বক ধারা চলছে।"
"করোনার সময় স্বাভাবিক ভাবেই বীমা পলিসির সংখ্যা কমেছে। তবে বীমা কোম্পানী গুলোর প্রতি আস্থার সংকট পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলেছে", যোগ করেন তিনি।
প্রগতি লাইফ ইনসুরেন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জালালুল আজীম বলেন, "২০২১ সালে বীমা খাত কিছুটা ভালো করেছে । ২০২২ সালে তা আরও ভালো হবে বলে প্রত্যাশা আছে। তবে এক্ষেত্রে গতানুগতিক যে পদ্ধতিতে আমরা কাজ করে থাকি সেখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। ডিজিটালাইজেশনের চিন্তা করতে হবে।"