“শীত থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের জামাকাপড় পুড়িয়ে আগুন ধরিয়েছি,” ইউক্রেন ছেড়ে পালানো সোমালীয়
রাশিয়া গত সপ্তাহে ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরু করার পর বাস্তুচ্যুত হয়েছেন সেদেশে অবস্থান করা হাজার হাজার আফ্রিকান, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষার্থী।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার মতে, এই সংঘাতের কারণে এখন পর্যন্ত ৬ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছে, ১০ লাখের মতো মানুষ ইউক্রেনের ভেতরই বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
মঙ্গলবার, ৩১ বছর বয়সী সোমালীয় যুব নেতা এবং ছাত্র যোগাযোগ কর্মকর্তা মোস্তফা মোহাম্মদের সাথে কথা বলে আল জাজিরা। মোহাম্মদ তখন পোল্যান্ড এবং ইউক্রেনের মধ্যকার প্রধান সীমান্ত ক্রসিংয়ের সবচেয়ে কাছের শহর প্রজেমিসলের একটি রিসিপশন সেন্টারে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন।
এই প্রতিবেদনে মোহাম্মদের নিজের ভাষায় তার গল্প তুলে ধরা হলো:
"আমি প্রায় ১০ বছর ইউক্রেনে বসবাস করেছি। এখানে পড়াশোনা করতে এসেছিলাম আমি। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ডিগ্রি নিয়েছি। পড়াশুনা শেষ করার পর আমি এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এবং কাজ খুঁজতে থাকি। এখানে একটি ক্রমবর্ধমান আফ্রিকান সম্প্রদায় রয়েছে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই শিক্ষার্থী। আমি ইউক্রেনীয় ভাষাও শিখে ফেলেছি। তাই একসময় সিদ্ধান্ত নেই, ছাত্র যোগাযোগ কর্মকর্তা হব।
"যুদ্ধের আগে, সবকিছু স্বাভাবিক ও শান্ত ছিল। মানুষের মুখে হাসি ছিল। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সবকিছু বদলে গেছে। আমার শহর ভিনিৎসিয়ায় হঠাৎ করে একটি সাইরেন বেজে ওঠে। তারপর আরেকটি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাজতে শুরু করে সাইরেন।
"এরপর খুব বড় একটি আওয়াজ শুনতে পাই আমরা। সাথে সাথে চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শহরে একটি সামরিক স্থাপনা আছে। মানুষ বলতে শুরু করে, সেই স্থাপনাকে টার্গেট করা হয়েছে।
"আমি কখনো কল্পনাও করিনি এখানে যুদ্ধ হবে। রাজনীতিবিদরা অনেক কিছুই বলেন, কিন্তু বেশিরভাগ সময় এগুলো করতে যান না তারা।
"সেই স্থাপনাকে কেন্দ্র করেই বিস্ফোরণটি হয়েছিল। তখন আমি সিদ্ধান্ত নেই জীবন বাঁচাতে হলে আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে।
"এখানে অনেক সোমালীয় শিক্ষার্থী রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সোমালিয়া থেকে এসেছে; অন্যান্য সোমালীয়রা এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের মতো পশ্চিমা দেশ থেকে। বেশিরভাগই ডাক্তারি পড়ে। যাদের কাছে পশ্চিমা পাসপোর্ট ছিল তাদের দূতাবাস তাদেরকে যুদ্ধের আগেই সরিয়ে নিয়েছে। আমরা যারা সোমালি পাসপোর্টধারী, আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। বৃহস্পতিবার আমরা সবাই এক হয়ে সিদ্ধান্ত নেই, আমাদের এই দেশ ছাড়তে হবে। কারণ, এই জায়গা আর নিরাপদ না।
ইউক্রেনীয়রা আগে
"কোনো ট্রেন ছিল না। সবাই বাসে উঠার চেষ্টা করছিল। বাস না থাকলে যা চলছে তা-ই। কর্মকর্তারা ইউক্রেনীয়দের অগ্রাধিকার দিয়েছেন। সব ইউক্রেনীয় গণপরিবহনে উঠার পরই কেবল অন্যান্য জাতীয়তার মানুষদের তোলা হয়েছে। আমরা, সোমালিরা সিদ্ধান্ত নেই আমরা অপেক্ষা করব না। কারণ তখনো হাজার হাজার ইউক্রেনীয় এই যুদ্ধ থেকে পালানোর চেষ্টা করছে।
"কোনোমতে পোলিশ সীমান্তে নিয়ে যাবে, এমন ছোট ছোট বাস ভাড়া করি আমরা। তারা স্বাভাবিক চেয়ে বেশি ভাড়া নেয় আমাদের কাছ থেকে।
"মোট ৮৮ জন ছিলাম আমরা। শুক্রবার রওনা দেই সবাই মিলে। নারী ও যারা ইউক্রেনীয় ভাষা জানে না, নিরাপত্তার স্বার্থে তাদেরকে প্রথম বাসে তুলি আমরা। কারণ, কোনোকিছু হলে অন্তত আমরা যারা ইউক্রেনীয় বলতে পারি তারা যেন বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারি। এরপর আমরা বাকিরা দুটি বাসে গাদাগাদি করে বসে সীমান্তের উদ্দেশ্যে রওনা হই।
"দোকানে কোনো খাবার ছিল না। তড়িঘড়ি করে সবাই সাপ্লাই নিয়ে গেছে। এটিএমগুলোতেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি টাকা তুলতে দিচ্ছিল না।
"সীমান্তের ট্রাফিক ছিল একেবারে অসহনীয়। যে রাস্তা ছয়ঘণ্টায় যাওয়া যায়, সেটি যেতে আমাদের সময় লেগেছে প্রায় দুই দিন।
"আমরা যখন সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে, তখন যান চলাচল একেবারে বন্ধই হয়ে যায়। কোনো গাড়িই নড়ছিল না। আমরা বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করি। সেখানে আশেপাশে তাকিয়ে দেখি, যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর গাড়ি।
"সীমান্তে পৌঁছার পর দেখি, অবস্থা আরও খারাপ। গার্ডরা এতো লোকজন সামলাতে পারছিল না। তারা ক্রমাগত চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকে। মানুষও ধাক্কাধাক্কি করতে থাকে, চেঁচামেচি করতে থাকে। সবাই খুব চাপে ছিল। কোনো খাবার ছিল না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা জেঁকে ধরেছিল। শিশুরা কাঁদছিল।
"রক্ষীরা একবারে ৬০০ জনকে যেতে দেয়। ইউক্রেনীয়রা প্রথমে। অবশ্যই। প্রথমে ইউক্রেনীয় নারী ও শিশুদের ঢুকতে দেয় তারা। এরপর ইউক্রেনীয় পুরুষদের। আমরা বাকিরা পালা ধরে অপেক্ষা করি।
"আমি আজ (১ মার্চ) সীমান্ত পার হয়েছি। যখন অপেক্ষা করছিলাম তখন আমাদের কাছে খাওয়ার মতো কিছু ছিল না। রওনা দেওয়ার আগে দোকান থেকে কেনা চকোলেট বারের উপর নির্ভর করে বাঁচতে হয়েছে আমাদের। রাতে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে। গতকাল রাতে এতই ঠান্ডা পড়েছিল ছিল যে গরম থাকার জন্য আমাদের কিছু জামাকাপড় এবং ব্যাগ পোড়াতে হয়েছে। আমাদের কাছে আগুন জ্বালানোর মতো আর কিছুই ছিল না।
"সীমান্ত থেকে পোলিশ কর্তৃপক্ষ আমাদের বাসে করে এখানে (প্রজেমিসল রিসিপশন সেন্টার) নিয়ে আসে। এই জায়গাটা উষ্ণ। এখানে খাবার আছে, টয়লেট আছে। আমরা গোসল করতে পারছি।
"শুক্রবারের পর এই প্রথম আমি কোনো বিছানায় ঘুমাব। এরপর কী করব তা ঠিক করিনি। আমি মাত্র এসেছি। আমি হারগেইসার (উত্তর সোমালিয়া) মানুষ। সেখানকার লোকজন বলে, 'শুষ্ক মৌসুমে ঘাসের বিকল্প নেই।' নিশ্চিতভাবেই, আজকের দিনে ইউক্রেনের চেয়ে আমাদের বাড়ি (সোমালিয়া) বেশি নিরাপদ।"
(আল জাজিরা থেকে অনূদিত)