হাওরের প্রাথমিক শিক্ষা: ৪ ওয়ার্ডে বিদ্যালয় মাত্র ১টি, নিশ্চত হচ্ছে না মানসম্মত শিক্ষা
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রত্যেক গ্রামে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। অথচ নেত্রকোনার হাওরদ্বীপ খ্যাত খালিয়াজুরী উপজেলার একটি ইউনিয়নের প্রায় চারটি ওয়ার্ডের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চলছে মাত্র একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় দিয়ে। তা-ও আবার খোদ খালিয়াজুরী উপজেলা সদরেই চলছে এমন অবস্থা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খালিয়াজুরী সদর ইউনিয়নের প্রায় ৪টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত খালিয়াজুরী গ্রাম। ২২টি পাড়া বা মহল্লা নিয়ে গঠিত গ্রামটির কোনো কোনো পাড়া বা মহল্লা ওই উপজেলার অন্য অনেক গ্রামের চেয়েও বড়। আবার কয়েকটি গ্রাম উপজেলা সদর থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন।
তাই একটিমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকার কারণে সেখানকার অনেক শিক্ষার্থী সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে তাদের পড়তে হচ্ছে এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয় বা কিন্ডারগার্টেনে। আবার ধারণক্ষমতার বেশি শিক্ষার্থী নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে একমাত্র সরকারি বিদ্যালয়টিরও।
খালিয়াজুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছানোয়ারুজ্জামান জোশেফ জানান, খালিয়াজুরী সদর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের লক্ষ্মীপুর, নয়াপাড়া, বানিয়াপাড়া, কলেজপাড়া, সরকারহাটি, কড়িয়াহাটি, ২নং ওয়ার্ডের দীঘলহাটি, পুরানহাটি, ৩নং ওয়ার্ডের উত্তরহাটি, বাদিয়াহাটি, পশ্চিমহাটি, ছোটহাটি, ৪নং ওয়ার্ডের বড়হাটি, বানিয়াহাটি, কাচারিহাটি, ভাঙ্গাহাটি, মুসলিমহাটি, দাসহাটি, মুসলিমপাড়া (নয়াহাটি), কৃষ্টপুর, সিদ্দিকপুর ও রূপনগর এলাকা নিয়ে খালিয়াজুরী গ্রাম। গ্রামটিতে স্থায়ীভাবে বসবাসরত পরিবারের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭ হাজার। উপজেলার সব সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতও এ গ্রামে অবস্থিত। তাই স্থায়ী বাসিন্দাদের বাইরে অফিসপাড়ার অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীও অস্থায়ীভাবে বাস করেন সেখানে। অথচ বিপুল জনসংখ্যার এই জনপদে মাত্র একটিই প্রাথমিক বিদ্যালয়, যার নাম খালিয়াজুরী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত এটি।
২০২১ সালে পরিচালিত এক জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে খালিয়াজুরী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইন্দ্রজিৎ বর্মন জানান, ২২টি পাড়া বা মহল্লা নিয়ে গঠিত খালিয়াজুরী গ্রামে ১০ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুর সংখ্যা ১ হাজার ১১০ জন। এর মধ্যে খালিয়াজুরী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি আছে ৪৭১ জন। বাকি ৬৩৯ জন শিশুর বেশিরভাগ এনজিও পরিচালিত ২টি উপ-আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি কিন্ডারগার্টেন, ১টি মাদ্রাসা ও ১টি মন্দিরভিত্তিক বিদ্যালয় বা অন্য কোথাও লেখাপড়া করছে। আবার কেউ কেউ কোনো বিদ্যালয়েই যাচ্ছে না। এদিকে আবার বেসরকারিভাবে পরিচালিত এসব বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান নিয়েও অসন্তোষ আছে স্থানীয়দের মধ্যে।
খালিয়াজুরীর মুসলিম হাটি এলাকার অভিভাবক আবুল হোসেন বলেন, কাছাকাছি বিদ্যালয় না থাকায় বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোর শিক্ষার্থীরা বর্ষাকালে বিদ্যালয়ে আসতে-যেতে পারে না। এ কারণে তখন তারা বিদ্যালয়বিমুখ হয়ে পড়ে। আর দীর্ঘদিন বিদ্যালয়বিমুখ থাকার কারণে অনেকে শিক্ষা থেকে ঝরেও যায়।
প্রধান শিক্ষক ইন্দ্রজিৎ আরও বর্মন বলেন, 'খালিয়াজুরী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ আছে মাত্র চারটি। এই চারটি কক্ষে ৪শ ৭১ জন শিক্ষার্থীর পাঠদান পরিচালনা করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে একটি শ্রেণিকক্ষে যেখানে সর্বোচ্চ ৩৫ জন শিক্ষার্থী রাখার কথা বলা হচ্ছে সেখানে আমাদের কোনো কোনো শ্রেণিতে ১০০ শিক্ষার্থীকেও পড়াতে হচ্ছে।
'এলাকায় নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। এরপরও ক্যাচমেন্ট (নির্ধারিত) এলাকার কোনো অভিভাবক তার শিশুকে ভর্তি করতে এলে আমরা ভর্তি করি। কিন্তু বিদ্যালয়টির অবস্থা দেখেই অনেকে তাদের শিশুদের নিয়ে এনজিওর স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করে দেন।'
খালিয়াজুরী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সুমন চক্রবর্তী বলেন, খালিয়াজুরী উপজেলা সদরে মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে দুটি। অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয় মাত্র একটি। এখানে আরও অন্তত দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রয়োজন।'
একইরকম মন্তব্য করেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ছানোয়ারুজ্জামান জোশেফও। তিনি বলেন, লক্ষ্মীপুর, সিদ্দিকপুর, রূপনগর, নয়াপাড়া, কিষ্টুপুর ও বানিয়াপাড়ার শিশুদের বেশ দূর থেকে বিদ্যালয়ে আসতে হয়। তাছাড়া লক্ষ্মীপুর, রূপনগর ও সিদ্দিকপুর এলাকাগুলো সদর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নও। বর্ষায় সেখানকার বাসিন্দাদের নৌকায় যাতায়াত করতে হয়।'
জনসংখ্যা বিবেচনা করে লক্ষ্মীপুর ও কৃষ্টপুরে আরও দু'টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সমূহ সম্ভাবনা আছে বলে জানান তিনি।
খালিয়াজুরী উপজেলা শিক্ষা অফিসার (প্রাথমিক) রফিকুল ইসলাম বলেন, 'একটিমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় দিয়ে এখানকার চাহিদা পূরণ হচ্ছে না এটা সত্য। এখানকার লক্ষ্মীপুর ও কৃষ্টপুরে আরও দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমরা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি।'
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ ওবায়দুল্লাহ বলেন, 'বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য একটি সরকারি প্রকল্প আছে। ওই প্রকল্পের আওতায় খালিয়াজুরীতে আরও দু-একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ করে যাচ্ছি।'
মো. ওবায়দুল্লাহ আরও বলেন, 'হাওরের উপজেলাগুলোতে এমন আরও অনেক এলাকা আছে যেখানে জনসংখ্যা বা শিশুর সংখ্যার তুলনায় বিদ্যালয়ের সংখ্যা কম। সেগুলো নিয়েও ভাবছি আমরা।'