হাতি চলাচলের মূল বাধা রেললাইন-মহাসড়ক-শরণার্থী ক্যাম্প, ১২ করিডর সংরক্ষণের উদ্যোগ
কক্সবাজারের উখিয়া থেকে মিয়ানমার ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে হাতি চলাচল করতো উখিয়া-ঘুমধুম করিডর দিয়ে।
দুই দেশে হাতি চলাচলের এই আন্তজার্তিক করিডরে শরণার্থী ক্যাম্প করা হলে করিডরটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এই পথে আটকা পড়েছে প্রায় ৪০টির মতো হাতি।
চলাচলের পথ বন্ধ হওয়ায় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২০১৮ এর ফেব্রুয়ারি, এ পাঁচ মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় হাতির আক্রমণে অন্তত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
করিডরগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চলাচলে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে হাতি। এ কারণে মানুষের সঙ্গে হাতির সংঘাত বাড়ছে। ফলে মরছে মানুষ। মরছে হাতিও।
১২টি করিডর সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা ঢাকার তিন বাসিন্দা আদনান আজাদ, ফারজানা ইয়াসমিন ও খান ফাতিম হাসান। এর প্রেক্ষিতে গত ২১ নভেম্বর করিডোরগুলো সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে গেজেটভুক্ত করার আদেশ দেওয়া হয়। করিডরগুলো চিহ্নিত করতে উদ্যোগ নিয়েছে বন সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
জরিপের মাধ্যমে কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগ এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগে হাতি চলাচলের এসব করিডর চিহ্নিত করেছে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন)। তবে করিডর স্থাপনা গড়ে ওঠায় এসব করিডর সংরক্ষণের উদ্যোগের বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
হাতি গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "হাতির জন্য বড় জায়গা প্রয়োজন। এক স্থানের হাতি অন্য স্থানে গিয়ে খায় না এবং প্রজননও করে না। হাতির করিডরগুলো খুলে না দিলে একসময় বন্য হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কী চাই।"
"বন্য হাতি রক্ষা করতে চাইলে অবশ্যই করিডরগুলো খুলে দিতে হবে। স্থাপনা সরাতে হবে। এর বিকল্প নেই। কাগজে-কলেমে অনেক কিছুই থাকে। কিন্তু বাস্তবায়ন আবশ্যক," বলেন তিনি।
আইইউসিএনের মাঠ পর্যায়ের জরিপের তথ্যমতে, উখিয়া-ঘুমধুম করিডরের সংরক্ষণে প্রধান হুমকির মধ্যে রয়েছে গড়ে ওঠা কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক, রোহিঙ্গা ক্যাম্প, প্রস্তাবিত দোহাজারি-ঘুমধুম রেললাইন, উখিয়া টিভি স্টেশন, রাবার বাগান, কুমিরের খামার, লোকালয়, ফসলি মাঠ, গোচারণভূমি।
উখিয়া-ঘুমধুম করিডর ছাড়াও কক্সবাজার বন বিভাগ উত্তরের ২টি ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের ১টি করিডর সংরক্ষণের প্রধান বাধা প্রস্তাবিত দোহাজারি-ঘুমধুম রেললাইন।
খুন্তাখালী-মেধাকচ্ছপিয়া, ফাঁসিয়াখালী-চেয়ারখালী এবং চুনতি-সাতঘর করিডর সংরক্ষণে রেললাইন ছাড়াও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক, লোকালয়, ফসলি মাঠ, মসজিদ-মাদ্রাসা, ফিস কালচার ও খামার মূল বাধা।
অন্যদিকে, তুলাবাগান-পানেরছড়া করিডর দিয়ে হিমছড়ি সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে রাজারফুল ও পানেরছড়া রেঞ্জ দিয়ে যাতায়াত করে হাতি। কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক, সেনা ক্যাম্প, সড়ক, সামাজিক বনায়ন, মোনা কালচার, ফসলি মাঠ ও গোচারণ ভূমি এই করিডর সংরক্ষণে প্রধান বাধা।
নাইক্ষ্যংছড়ি-রাজারকুল করিডর সংরক্ষণের প্রধান চ্যালেঞ্জ রামু-মরিচ্ছা সড়ক, সেনানিবাস, বিজিবি ক্যাম্প, নারকেল বাগান, বোটানিকাল গার্ডেন, মানববসতি, ফসলি মাঠ ও গোচারণ ভূমি।
ভোমারিয়াঘোনা-রাজঘাট এবং তুলাতুলি-ঈদগাঁ, এই দুই করিডর দিয়ে ঈদগাঁও সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে ফুলছড়ি সংরক্ষিত বনাঞ্চল, ভোমারিয়াঘোনা ও তুলাতুলি হাতি যাতায়াত করে। করিডর দুটি সংরক্ষণে প্রধান বাধা ঈদগাঁও সড়ক, আশ্রয় কেন্দ্র, লোকালয়, ফসলি মাঠ।
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী-মানিকপুর করিডর দিয়ে ওইখানকার বনাঞ্চল ও ইয়াংছা পাহাড়ে হাতি যাতায়াত করে। লামা সড়ক, লোকালয়, ফসলি মাঠ, গোচারণভূমি করিডর সংরক্ষণের প্রধান বাধা।
চট্টগ্রাম উত্তর বনাঞ্চলের লালুটিয়া-বারদুয়ারা করিডর দিয়ে দোহাজারি বন থেকে পদুয়া, লালুটিয়া ও বারদুয়ারা যাতায়াত করে হাতি। কেরানীরহাট-বান্দরবান মহাসড়ক, সেনানিবাস, বিজিবি ক্যাম্প, বোম্বিং জোন, লোকালয়, ফসলি মাঠ, গোচারণভূমি এ করিডর সংরক্ষণে প্রধান চ্যালেঞ্জ।
এছাড়া সুখ বিলাস-কোদালা ও নারিশ্চা-কোদালা করিডর সংরক্ষণে প্রধান চ্যালেঞ্জ সড়ক, লোকালয়, ফসলি মাঠ ও গোচারণভূমি।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "১২টি করিডর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রথমে, করিডরগুলোর জায়গা চিহ্নিত করা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কীভাবে চিহ্নিত করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।"
বাড়ছে হাতি-মানুষের সংঘাত
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রাকৃতিক সংরক্ষণ বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৯৯টি হাতির আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।
এরমধ্যে পৃথক ২৪টি ঘটনায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ১৩৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছেন।
অথচ ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮, এ তিন বছরে হাতি আক্রমণের ঘটনা ছিল ৫৫টি।
এসব ঘটনায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন ৭১ জন। এ পরিসংখ্যানে হাতি আক্রমণের ঘটনা দ্বিগুণ হাওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
অপরদিকে ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত তিন বছরে চট্টগ্রামের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা এবং কক্সবাজার বনাঞ্চলে অন্তত ৪৫টি হাতির মৃত্যু হয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ রাকিবুল আমিন টিবিএসকে বলেন, "হাতি চলাচলের করিডরগুলোর মধ্যে বন বিভাগের জমিগুলো সংরক্ষণ করা যাবে সহজে। কিন্তু এর বাইরে ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমিসহ বিভিন্ন স্থাপনাই এখন মূল সমস্যা।"
করিডর দিয়ে চলাচলে বাধাগ্রস্থ হয়েই নতুন নতুন স্থানে হাতির সংঘাত বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমরা ১২টি করিডর সংরক্ষণ করতে সুপারিশ করেছি। বন উজারসহ নানা কারণে হাতি লোকালয়ে চলে আসছে। খাবারের সন্ধানে আসছে, এতে সংঘাত বাড়ছে।"