‘দেখা হবে বন্ধু রাজপথে, ব্যস্ত সড়কে যাব বহুদূর’
পাবলিক যানবাহনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে এবং নারীদের যাতায়াত পথকে সহজ করে তুলতে ২০১৮ সালে 'যাব বহুদূর' নামক স্কুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেন আতিকা রোমা। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৪৮৮জন নারীকে স্কুটি প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যার মধ্যে কর্মজীবী নারীর সংখ্যাই ছিল বেশি।
পাবলিক যানবাহনগুলোতে চলাচলের সময় নারীরা সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয়। ২০১৬ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, পাবলিক বাসে চলাচলকারী ৪১ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন।
"যেখানে বাংলাদেশের বেশিরভাগ নারী সব ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, সেখানে একজন নারী রাস্তা দিয়ে বাইক চালাবে এটা খুব চ্যালেঞ্জিং আর সমাজের চোখে বেমানান ছিল। আমি যখন এই উদ্যোগ নেই আমাকে অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আমার এই কাজে আমাকে থামানো হয়েছিল বারবার, কিন্তু দমাতে পারেনি কেউ," বলছিলেন আতিকা রোমা।
যাব বহুদূরের পথচলা
২০০৯ সাল থেকে আতিকা রোমা বাইক চালান। ২০১৭ সালে বাইক চালিয়ে মাত্র আড়াই দিনে ১২৫০ কি.মি পাড়ি দেন। প্রথম নারী বাইকার হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু রাস্তা (বান্দরবানের থানচি থেকে আলিকদম পাহাড়, সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ২৫০০ মি. উঁচু) বাইকে পাড়ি দিয়ে রেকর্ড গড়েন।
বন্ধু, পরিচিত, অপরিচিত অনেকেই তাকে বলতেন তিনি এতো ভালো বাইক চালাতে পারেন, কেন তিনি অন্যদের শেখাচ্ছেন না? কিন্তু যে বিষয়টি আতিকা রোমাকে নাড়া দেয় সেটি হলো, তার ফেসবুকে একজন বাবা হঠাৎ একদিন লিখলেন 'আপনি একাই চালাবেন আমাদের মেয়েদের কি হবে? সেই ছোট্ট কথাটি সেই সময় বাংলাদেশের নারীদের বাসে চলাচলের অনিরাপত্তা ও যৌন হয়রানির পুরো চিত্রটি নিয়ে তাকে ভাবাতে শুরু করলো। তিনি প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে দেখতেন নারীদের জামা কেটে দেওয়া হচ্ছে এবং বাসে ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে।
সেখান থেকে তিনি চিন্তা করতে লাগলেন এতো এতো সফলতা আর পাহাড়-পর্বত জয় করছেন তিনি, কিন্তু ঐদিকে অন্য নারীরা যাতায়াতে এখনো স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারছে না। তাই নিজের সফলতার মালা গাথার আগে ঐসব কর্মমুখী নারীদের যাতায়াতের পথকে সুরক্ষিত করে তুলতে হবে। সেখান থেকে উদ্যোগ নিয়ে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে যাব বহুদূরের পথচলা শুরু হয়।
'উইমেন চ্যাপ্টার' নামক নারীদের মতামত প্রকাশের অনলাইন প্লাটফর্মে বাইক চালানো নিয়ে আতিকা রোমা একবার লিখেছিলেন, "দেখা হবে বন্ধু রাজপথে, ব্যস্ত সড়কে যাব বহুদূর"। সেখান থেকে তিনি তার এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নাম রাখেন 'যাব বহুদূর'।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি চালু করার আগে আতিকা রোমা নামকরা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করতেন। নিশ্চিত ভবিষ্যতের পথ রেখে অনিশ্চিত কোন পথে হাটার পরিকল্পনা কে অনেকেই নিছক পাগলামি মনে করেছে। অনেকে বলেছিল বাংলাদেশের নারীরাই তার এই উদ্যোগে এগিয়ে আসবে না। কিন্তু শুরু থেকে তার মা তাকে সাহস ও আস্থা জুগিয়ে গেছে। মায়ের বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে সম্পূর্ণ একা নিজ উদ্যমে এগিয়ে চলেন তিনি।
নারীদের বাইক চালানো শেখাবেন তাই জায়গা ভাড়া পেতেন না
প্রশিক্ষণ সেন্টারের জন্য জায়গা খুঁজে পাওয়াটা একটা যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল আতিকা্র জন্য।
"যখন আমি প্রশিক্ষণের জন্য জায়গা ভাড়া নিতে যাই, তখন নারীদের বাইক চালানো শেখাবো এই কথা জানতে পেরে অনেকেই আমাকে না করে দেয়। প্রথম তিনমাস জায়গা খুঁজতে গিয়ে দ্বারে দ্বারে ধাক্কা খেয়ে ফিরতে হয়েছিল আমাকে। তারপর 'বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা' এগিয়ে আসে, ধানমন্ডির সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীয়া কমপ্লেক্সে নারীদের স্কুটি চালানোর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র 'যাব বহুদূরের' জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়," বলেছিলেন আতিকা।
আতিকা রোমা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ- নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ভ্রমণে গিয়ে দেখতে পান সেখানকার নারীরা বাইকের থেকে স্কুটিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তিনি ভেবে দেখলেন বাঙালি নারীরা যে কোন পোশাক পরে স্কুটি চালাতে পারবে, যা হয়তো বাইকের ক্ষেত্রে সম্ভব হবে না। নারীদের স্বাচ্ছন্দ্য ও পোশাকের কথা মাথায় রেখে তিনি বাইকের বদলে প্রশিক্ষণ দিতে স্কুটিকে বেছে নিলেন। 'যাব বহুদূরে' নারীদের প্রশিক্ষণ দিতে রয়েছে তিনটি স্কুটি। তাই প্রশিক্ষণ নিতে আসা নারীদের বাইক/স্কুটি থাকাটা বাধ্যতামূলক না।
যাব বহুদূরে প্রতিটি ব্যাচে নয়জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতিটি ব্যাচকে সাতদিন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে তা কমিয়ে প্রতি ব্যাচে ছয়জন করা হয়। ন্যূনতম ফি জমা দিয়ে যে কেউ স্কুটি চালানো শিখতে পারবে এখান থেকে।
স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নরওয়ে ও ভারত থেকে অনেক প্রবাসী বাঙালি দেশে এসে 'যাব বহুদূর' থেকে স্কুটি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ৫৬ বছর বয়সী একজন নারী স্কুটি শিখতে এসে জানিয়েছিলেন, কলকাতায় স্কুটি শেখার কোন সংগঠন নেই, তাই নিজের ইচ্ছাপূরণ করতে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন 'যাব বহুদূর' থেকে স্কুটি চালানো শিখতে।
'মেয়েদের এভাবে রাস্তায় নামাচ্ছেন কেন?'
"যাতায়াতের সুবিধার জন্য আমি সবসময় বাইক ব্যবহার করতাম। রাস্তা দিয়ে চালিয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ই আমার ওপর ইট, ঢিল ছুড়ে মারতো লোকজন। এরকম ঘটনা বহুবার হয়েছে। এমনকি একবার রমজান মাসে আমি বাইক চালিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলাম, কে যেন পেছন থেকে আমার ওপর থুথু ছুড়ে মারলো। তখন আমার মনে হতো মেয়ে বাইক চালাচ্ছে এটার জন্য তাদের এতো ক্ষোভ কেন? কই কোন পুরুষ বাইকাদের তো রাস্তায় হেনস্তা বা এভাবে আঘাত করা হচ্ছে না!"
আতিকা রোমা যখন নারীদের বাইক চালানোর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলেন তখন তাকে নানারকম চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। তথাকথিত কিছু ইসলামিক গ্রুপ তাকে নজরদারিতে রেখেছিল, তাকে বিভিন্নভাবে তাকে হুমকি দিতে থাকে।
এমনকি তাকে বলা হয়েছিল কেনো 'তিনি এভাবে মেয়েদের রাস্তায় নামাচ্ছেন'। এগুলো 'ইসলাম পরিপন্থী' কাজ। যদি তিনি এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি বন্ধ না করেন তাহলে তাকে মেরে ফেলা হবে এমন হুমকিও দেওয়া হয়। একাধিকবার হুমকি ও আঘাত আসতে থাকলে আতিকা রোমা নিজের নিরাপত্তার জন্য আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেসময় পুলিশ ও র্যাবের ইন্টেলিজেন্স থেকে এ নিয়ে তাকে সহায়তা করা হয়।
আতিকা বলেন, "একদিন আমাকে ধানমন্ডিতে রাস্তায় আটকে হুমকি দেওয়া হয়, আমি যেন আমার কাজ থেকে সরে আসি। চারিদিক থেকে এতো চাপের মুখে পড়েছিলাম যে মনোবল ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। তখন আমার মা ছিল আমার শক্তি। তিনি আমাকে বললেন, তুমি যদি ভয় পাও তাহলে তুমি বারবার মরে যাবে, তাই চাপে পরে নারীদের জন্য নেওয়া এই উদ্যোগ থেকে সরে না এসে সাহসের সাথে যেন সামনে এগিয়ে যাই। সেখান থেকে সব ভয় আর হুমকিকে সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলছি। আমি চাই আমি না থাকলেও নারীরা যেন নিজ উদ্যোগে স্বনির্ভর হয়ে উঠে। তাদেরকে যেন রাস্তায় চলতে গিয়ে বাবা, ভাই, বন্ধুর কাছে সাহায্য চাইতে না হয়"।
কিছু বাইক কোম্পানি ও রাইড শেয়ারিং কোম্পানি যাব বহুদূরের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে চেয়েছিল নিজেদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। কিন্তু কারও কোনো প্রকার আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াই শুরু থেকে একা এই প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন আতিকা। তার লক্ষ্য ছিল নিরাপদে যাতায়াতের জন্য অধিক সংখ্যক নারীকে বাইক চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া। তাই তিনি ব্যবসায়িক লাভের চিন্তা থেকে সরে আসেন।
স্বপ্ন ও সফলতা
সমাজের দৃষ্টিতে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চাবিকাঠি মনে করা চাকরি ছেড়ে দিয়ে অনিশ্চিত পথে হাঁটা আতিকা অনেক নারীদের চলাচলের পথকে সহজ করে দিয়েছেন। তার এই অবদানের জন্য পেয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্মাননা ও পুরষ্কার।
২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবসে 'অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশন' নারীদের বাইক চালানো শেখানোর জন্য তাকে সম্মাননা প্রদান করে। ২০১৯ সালে 'আমেরিক্যান জন্টা ইন্টারন্যাশনাল' থেকে চেঞ্জ ম্যাকার অ্যাওয়ার্ড পান। ওই একই সালে 'উইমেন অ্যান্ড লিডারশিপ' তাকে পাওয়ারফুল উইমেন খেতাবে অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে।
আতিকা রোমা 'যাব বহুদূর' এর প্রতিষ্ঠাতার পাশাপাশি একজন সমাজকর্মী। 'অমৃতম' নামের একটি ফাউন্ডেশন রয়েছে তার, যেখানে তিনি প্রতিদিন ৬০জন শিশুকে খাবার দেন, মাসে একবার তাদের চিকিৎসা সেবা দেন। এদের মধ্যে ৩৫জন শিশুর তিনি স্কুলে ভর্তি ও পড়াশোনার খরচ বহন করেছেন।
"কয়েক বছর আগেও রাস্তায় বাইক চালানোর সময় সিগন্যালে যখন থামতাম, তখন আশেপাশে তাকিয়ে দেখতাম আমি ছাড়া সেখানে আর কোন নারী বাইকার নেই। কিন্তু এখন রাস্তায় প্রায় নারীদের বাইক, স্কুটি চালাতে দেখা যায়। আবার অনেক নারীরা রাইড শেয়ারিং সেবা দিচ্ছেন। নারীরা যে শুধু কর্মক্ষেত্রে স্বাবলম্বী তা নয়, চলাচলের ক্ষেত্রেও তারা দিনদিন স্বনির্ভর ও স্বাধীন হয়ে উঠছে"।
আতিকা রোমা বলেন, "আমার স্বার্থকতা আমি আমার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এবং এই কাজের মধ্যে দিয়ে প্রচুর মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। আমার প্রত্যাশা একদিন প্রতিটি নারী তাদের ভয় ও দুর্বলতাকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের চলাচলের পথকে নিজেরা সুরক্ষিত করার দায়িত্ব নিবে। তখন নারীরা এগিয়ে যাবে বহুদূর"।