নাবিকদের জয়গান
সমুদ্রে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোয় যোগ দেওয়া স্থানীয় নাবিকদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে— যা আসলে শিপিং খাতে (মেরিটাইম সেক্টরে) বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সামর্থ্যের ইঙ্গিত। এবং এই অগ্রগতির সদ্ব্যবহার করে বিশাল সমুদ্রসীমার অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোও সম্ভব।
মোহাম্মদ নুরুল করিমের উদাহরণই প্রথমে দেওয়া যাক। জাহাজের অভিজ্ঞ এ ক্যাপ্টেন ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। ৩২ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি ১৩টি দেশি-বিদেশি শিপিং কোম্পানিতে কাজ করেছেন। তার ব্যাচমেট এবং জুনিয়ররাও বাংলাদেশ এবং বিদেশের বিভিন্ন কোম্পানির জন্য বিশ্বব্যাপী সমুদ্রযাত্রা করছেন।
স্থানীয় নাবিকরা বলছেন, সমুদ্রগামী বাংলাদেশি জাহাজের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায়; তাদের চাকরির বাজারও কয়েক বছর ধরে প্রসারিত হচ্ছে। এছাড়া, স্থানীয় সরকারি -বেসরকারি মেরিটাইম ইনস্টিটিউটগুলি সমুদ্রযাত্রায় দক্ষ ক্রু যোগান দিতে আরও বেশি সংখ্যক নাবিক তৈরি করছে।
এসব সরকারি -বেসরকারি মেরিটাইম একাডেমি, ইনস্টিটিউট এবং ফিশারিজ একাডেমিতে এপর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার ক্যাডেট এবং দক্ষ নাবিক তৈরি করেছে, শেষোক্তদের বলা হয় রেটিংস। এদের মধ্যে, ১২ হাজার মেরিন অফিসার ও ক্রু বর্তমানে দেশি-বিদেশি জাহাজ ও সিলাইনারে কাজ করছেন। বিদেশি মালিকানার জাহাজে কর্মরত প্রায় ৮,৬০০ জন সমুদ্রচারী।
তারা প্রতিবছর দেশে প্রায় ৫২ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আনছেন।
মেরিন একাডেমি থেকে পাস করা প্রশিক্ষিত সমুদ্রচারীদের বলা হয় ক্যাডেট। আর মেরিন ইনস্টিটিউট থেকে পাসকারীরা হলেন নাবিক বা রেটিংস।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) তথ্যানুসারে, শিপিং খাতে সরাসরি যুক্ত স্থানীয়ভাবে স্নাতক সম্পন্ন করা প্রায় ৭ হাজার ক্যাডেট। এর মধ্যে ১৫শ জন নাবিক বাংলাদেশি জাহাজে এবং বাকী সাড়ে ৫ হাজার বিদেশি শিপিং লাইনে কর্মরত।
স্থানীয়ভাবে স্নাতক মোট ৫ হাজার রেটিংদের মধ্যে ৩ হাজার সরাসরি শিপিংয়ের সাথে জড়িত। এদের মধ্যে ১৫শ জন নাবিক বাংলাদেশি জাহাজে এবং বাকী ১৫শ জন বিদেশি নিয়োগকর্তাদের জন্য কাজ করেন।
অ্যাসোসিয়েশনটি জানাচ্ছে, একজন ক্যাপ্টেন প্রতিমাসে জাহাজভেদে ১০ - ১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত আয় করে থাকেন।
অন্যদিকে মেরিন ফিশারিজ একাডেমি থেকে পাস করা ক্যাডেটদের ৮৫ শতাংশ বিদেশে বিভিন্ন বাণিজ্যিক জাহাজে চাকরি করে। বাকী ১৫ শতাংশ বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার নৌযান এবং উপকূল ভিত্তিক মাছ প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট পরিচালনায় কাজ করছেন।
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির কমাড্যান্ট নৌ-প্রকৌশলী সাজিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "এই একাডেমি থেকে পাস করা ক্যাডেটরা আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনগুলোয় শীর্ষ-পর্যায়ে কাজ করছে। তারা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।"
মহামারিকালে দেশের সমুদ্রগামী বহরে ৩২টি জাহাজ যুক্ত করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা
২০২০-২০২২ এ দুই বছরে বাংলাদেশের শিপিং খাতে যুক্ত হয়েছে ৩২টি জাহাজ। এতে চলতি বছরের মার্চ নাগাদ, দেশের পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ৮১টিতে উন্নীত হয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারির অভিঘাতে সার্বিক অর্থনীতি মন্থর দশার মধ্য দিয়ে গেলেও- দেশের উদ্যোক্তারা তাদের বহরে নতুন জাহাজ যোগ করে একটি ইতিবাচক অগ্রগতির বার্তা দেন। উল্লেখ্য, ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ছিল ৪৮টি।
নৌ বাণিজ্য দপ্তরের তথ্যমতে, দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের মধ্যে ২৩টি কেএসআরএম- এর, এরপর মেঘনা গ্রুপের ১৬টি, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ৮টি, কর্ণফুলী গ্রুপের ৬টি, বসুন্ধরা গ্রুপের চারটি এবং ওরিয়ন গ্রুপের একটি জাহাজ।
এককভাবে সবচেয়ে বেশি জাহাজের মালিকানায় রয়েছে দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপ- কেএসআরএম। এসব জাহাজ পরিচালনায় ১২শ জন বাংলাদেশি নাবিক কাজ করে।
কেএসআরএম- এর পরিচালক সারোয়ার জাহান বলেন, "বাংলাদেশি নাবিক না থাকলে- বেশি বেতন দিয়ে আমাদের বিদেশ থেকে নাবিক আনতে হতো।"
আরেক বৃহৎ গোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপে কর্মরত ৭০০ মেরিন অফিসার ও ক্রু সদস্য। তাদের ৮০ শতাংশই স্থানীয়। মেঘনা গ্রুপের প্রধান প্রকৌশলী আবু তাহের বলেন, "মহামারির সংকটময় সময়ে আমাদের বিদেশি নাবিক আনতে হয়েছে। তবে এখন আমরা সকল পদে বাংলাদেশি নাবিক নিয়োগ দিতে চাই।"
কেএসআরএম- এর শীর্ষ কর্মকর্তা সারোয়ার জাহান বাংলাদেশের শিপিং সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য বেশকিছু পরামর্শ দেন। যার মধ্যে রয়েছে শিপিং খাতের জন্য ঋণের সুদহার কমানো, নতুন জাহাজ কেনার ক্ষেত্রে কর কমানো এবং কেনার ৫ বছরের মধ্যে তা বিক্রি করতে না পারার সরকারি সিন্ধান্ত প্রত্যাহার করা।
বর্তমানে দেশে আটটি সরকারি এবং সাতটি বেসরকারি মেরিন একাডেমি ও ইনস্টিটিউট রয়েছে।
ওশেন মেরিটাইম একাডেমির অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন কিউএন জামান বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরাও আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ব্যবসায় বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। এটি আমাদের জন্য গৌরবের।
তবে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পাস সংখ্যার ভিত্তিতে নয়; বরং আইএমও (ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন) এর মান- অনুযায়ী ক্যাডেট ও রেটিংস তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিপিং সংক্রান্ত বৃহৎ প্রতিষ্ঠান কনভেয়র গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক এটিকেএম কামাল টিবিএসকে জানান, "আইএমও কমপ্লায়েন্স পালন করতে না পেরে- প্রায়শই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।"
জাহাজের সাবেক এই ক্যাপ্টেন বলছেন, আইএমও মান অনুযায়ী, জাহাজ পরিচালনা করতে পারলে ইউরোপ-আমেরিকার বন্দরে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজ পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
অব্যবহৃত সম্পদের আঁধার গভীর সমুদ্রে যাত্রার এইতো সময়:
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের প্রায় ১.১৮ লাখ বর্গকিলোমিটার অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে, যা দেশের স্থলসীমানার প্রায় সমান। তবে সমুদ্রের বেশিরভাগ অঞ্চল আজো বিস্তর অনুসন্ধানের বাইরে রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ মাত্র ১৫ হাজার ৭০০ বর্গ কিলোমিটারে বিস্তৃত তিনটি অঞ্চল থেকে মৎস সম্পদ আহরণ করে। মাছ ধরার বার্ষিক পরিমাণ ছয় লাখ টন, যার মধ্যে ৩ -৪ হাজার টন চিংড়ি সম্পূর্ণরূপে জাপানে রপ্তানি করা হয়। বাকী মাছ স্থানীয় বাজারে পাওয়া যায়।
বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক সম্পদ জরিপের জন্য মালয়েশিয়া থেকে আনা গবেষণা জাহাজ আরভি মীন সন্ধানী ২৫টি মাছের প্রজাতির মজুদ নিরূপণ করেছে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের অন্য ৪৭৬ প্রজাতির মাছ ও ৩৯ প্রজাতির চিংড়ির মজুদ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।
মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, আধুনিক জাহাজের অভাবে গভীর সমুদ্রের একটি বিস্তীর্ণ অংশ এখনও অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। দেশ এখনও গভীর সমুদ্রে মাছের মজুদ জরিপ করতে পারেনি; এই তথ্যের ব্যবধানও বিনিয়োগের সুযোগের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
১ আগস্ট থেকে ২০ মে পর্যন্ত তথ্যানুসারে, বঙ্গোপসাগরে ২৬৩টি নিবন্ধিত গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার, ৬৭ হাজার নৌকা এবং ১৮০টি জাহাজ রয়েছে।
মাছ ধরার প্রতিটি ট্রলারে দুজন সনদপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন এবং দুজন প্রকৌশলী প্রয়োজন। কিন্তু পর্যাপ্ত সনদধারী প্রকৌশলীর অভাবে প্রায়শই ট্রলারগুলি টেকনিশিয়ানদের দ্বারা চালিত হয়।
প্রতিটি জাহাজে মোট ৪৪ জন ক্রু সদস্য হিসাবে- ৭,৯২০ জন অফিসার ও নাবিক-কর্মচারী ১৮০টি জাহাজে কাজ করেন।
এখাতের ব্যক্তিরা বলছেন, সামুদ্রিক ফিশারিজ ক্যাডেট এবং ক্রুরা সাধারণত মাছ ধরার জাহাজে এক থেকে দুই বছর কাজ করার পর বাণিজ্যিক জাহাজে চলে যায় - যার ফলে সেক্টরটি জনবল সংকটে ভুগছে। একারণে মাছ ধরার জাহাজগুলি অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করতে বাধ্য হয়।
পুরুষ আধিপত্যের জগতে বঞ্চিত নারীরা:
বাংলাদেশে মেরিন একাডেমিতে সর্বপ্রথম ২০১২ সালে নারী শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পায়। এপর্যন্ত ৮১ জন নারী ক্যাডেট পাস করে বেড়িয়েছে।
অনেক মহিলা মেরিটাইম স্নাতকই বলেছেন যে, কাজের সুযোগ সমান নয়। ৫০ শতাংশ মহিলা নাবিকদের প্রধানত লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে অন্য পেশায় যেতে হয়েছে।
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি থেকে ২০১৩ সালে পাস করা নারী ক্যাডেট বিউটি আক্তার জানান, তিনি স্নাতক হওয়ার পর থেকে এক বছরের "ফ্রি-টাইম" সহ মাত্র দুই বছর কাজ করেছেন।
"ফ্রি-টাইম" আসলে এক ধরনের ইন্টার্নশিপ- এক্ষেত্রে পুরুষ নাবিকদের পকেটমানি হিসাবে সম্মানী দেয় কোম্পানি।
বিউটি বলেন, "কোর্স শেষ করার পর ফ্রি টাইম করার জন্য বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিতে সিভি নিয়ে ঘুরেছি। কোনো কোনো অফিসে প্রবেশের পর্যন্ত অনুমতি দেওয়া হয়নি।"
পরবর্তীতে তাকে 'বাংলার শিখা' জাহাজে ১ বছর বিনা বেতনে ফ্রি টাইম করিয়ে দেয় বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন- বিএসসি। তিনি বঞ্চণার কথা তুলে ধরে বলেছেন, "চাকরির পেছনে ছোটা আর নিজেকে প্রমাণ করাটাই যেন এক নিত্য চ্যালেঞ্জ। ক্রমাগত বাধা আর অসহযোগীতায় কখনো কখনো মনে হয়, এই পেশায় এসে যেন অন্যায় কিছু করেছি।"
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, "নারীর ক্ষমতায়নে সরকারি উদ্যোগ এই সেক্টরে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। নারীদের জাহাজে চাকরি দেওয়ার বিষয়টি অনেক শিপিং কোম্পানি এখনও ভাবতেই পারে না।"
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এই বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বেশ কয়েকটি শিপিং কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু কেউ কথা বলতে রাজি হয়নি।
বাংলাদেশের সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতির তথ্যমতে, বেশিরভাগ বেসরকারি জাহাজ রিকন্ডিশন্ড এবং সেগুলো পুরুষ ক্রুদের কথা মাথায় রেখে ডিজাইন করা হয়েছে।
সমিতি আরও জানায়, মহিলা নাবিকদের নিয়োগ না করার পেছনে এটি একটি কারণ হতে পারে। পাশাপাশি, একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং ক্রু সদস্যরা যদি মহিলা সহকর্মী না চান- সেটাও বড় সমস্যা হতে পারে; যা কোম্পানিগুলোকে নারী নাবিক নিয়োগে নিরুৎসাহিত করে।