শ্রীলঙ্কায় এক কাপ চায়ের দাম এখন ২৯ টাকা
শ্রীলঙ্কায় প্রতি কাপ চায়ের দাম এখন ১০০ রুপি, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ২৯ টাকা। সোমবার দুপুর পর্যন্ত কলম্বোর প্রায় প্রতিটি চায়ের দোকানেই দেখা গেছে এই চিত্র।
চায়ের জন্য বিখ্যাত শ্রীলঙ্কায় প্রতি কাপ চায়ের এই অস্বাভাবিক এই দামের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নিজ দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশার বর্ণনা দেন শ্রীলঙ্কার ডেইলি নিউজে কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিক প্রবীণ মেন্দিস।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "এক কাপ চায়ের দাম প্রায় ১০০ রুপি (২৯ টাকা)। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় হুট করে চায়ের দামও বেড়ে গেছে। ৪০০ গ্রাম গুড়োদুধের প্যাকেটের দাম ৭৯০ রুপি (২৩১ টাকা)। চা বানাতে এই দুধের বিকল্প তো নেই।"
শ্রীলঙ্কার তীব্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়ে জানতে প্রবীণের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। নিজ দেশের কঠিন সময়ের নানাদিক তুলে ধরেন প্রবীণ।
"শ্রীলঙ্কার রুপির দরপতন ঘটেছে। শুধু গরীবরা নয়, অর্থনৈতিক সংকটের ভুক্তভোগী সকল শ্রেণির মানুষ। বিদ্যুৎ ও পানির মতো নাগরিক সুবিধাও মিলছে না। ফলে জনজীবনে ভয়াবহ ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে," বলেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলার না থাকায় জ্বালানি গ্যাস আমদানি করা যাচ্ছে না বলে শ্রীলঙ্কায় গ্যাস সরবরাহ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে বলেও উল্লেখ করেন প্রবীণ।
এদিকে নিত্যপণ্য কিনতে সড়কে দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত মানুষের লাইন কেবল দীর্ঘতর হচ্ছে। জ্বালানি স্টেশনগুলোতেও লম্বা লাইন।
"এক লিটার পেট্রোলের দাম প্রায় ৩৫০ রুপি। কিন্তু তারপরও সরবরাহ না থাকায় পেট্রোল মিলছে না। পেট্রোলের জন্যও মানুষকে দীর্ঘলাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে," বলেন তিনি।
জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘসময় ধরে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার কথাও জানান তিনি।
ঋণ সুবিধা পেতে শ্রীলঙ্কা আইএমএফের দ্বারস্থ হচ্ছে উল্লেখ করে প্রবীণ বলেন, "কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলার নেই। বৈদেশিক আয় আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করার অর্থ আমাদের নেই।"
মাত্র এক সপ্তাহ আগে কারেন্সি সোয়াপ বা মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কাকে ২৫ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ।
রাজাপাকসে সরকার ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পুরোনো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করে সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয় বলে উল্লেখ করেন প্রবীণ মেন্দিস।
শ্রীলঙ্কার জনগণ বর্তমান সরকারকেই এই সংকটাপন্ন পরিস্থিতির জন্য দায়ী করে বলে তিনি বলেন, মানুষ চায় সরকার যেন গদি ছাড়ে।
প্রবীণ বলেন, "গতকাল কারফিউ জারি করা হলেও বহু মানুষ কারফিউ ভেঙে বেরিয়ে আসে। মানুষ চায় সরকারের পতন। রাষ্ট্রপতি যেন পদত্যাগ করে নতুন সরকার গঠনের সুযোগ করে দেয় এটাই তাদের প্রত্যাশা।"
সোমবার শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব রাজনৈতিক দলকে মন্ত্রীত্ব গ্রহণে আমন্ত্রণ জানান। তিনি ঐক্যবদ্ধভাবে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলার আহ্বান করেন।
প্রবীণের মতে, জনসমর্থন না থাকায় বর্তমান সরকার দীর্ঘসময় সংসদে থাকার সুযোগ পাবে না।
শ্রীলঙ্কায় ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবাই ভোগান্তিতে দিন কাটাচ্ছে। "বিত্তশালী পরিবারগুলোও সুখে নেই। তাদেরও বিভিন্ন পণ্যের প্রয়োজন পড়ছে। এই প্রশাসনের পদত্যাগ চায় তারা," বলেন তিনি।
অতিমাত্রায় বৈদেশিক ঋণের কারণে এর আগে চলতি বছরই বিশেষজ্ঞরা সরকারকে অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে সতর্ক করে।
প্রবীণ আরও বলেন, "এমনকি শ্রীলঙ্কার বিরোধীদলও বিষয়টি নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল। এই তো গত জানুয়ারিতে সরকারকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল।"
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক ঋণের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ও কোভিড মহামারির কারণে পর্যটন ব্যবস্থা থমকে যাওয়া; এ দুইটি কারণও দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক ধসের জন্য দায়ী।
তবে অভিজ্ঞ এই সাংবাদিক শীঘ্রই অবস্থা ভালোর দিকে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
এর আগে এদিন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর পুত্রসহ মন্ত্রীসভার বেশ কয়েকজন সদস্য পদত্যাগ করেন। তার দুই দিন আগে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হলে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন।
আজকের মধ্যেই শ্রীলঙ্কার নতুন মন্ত্রীসভার শপথ নেওয়ার কথা। এ মন্ত্রীসভার প্রাথমিক কাজ হবে জনগণের বিক্ষোভ কমাতে কার্যকরী কিছু পদক্ষেপ নেওয়া।
প্রবীণ মনে করেন, যদি শ্রীলঙ্কার সরকারে কোনো পরিবর্তন হয় তাহলে তাতে জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটতে পারে।
"যদি শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রশাসন পরিবর্তিত হয় ও তার বদলে নতুনভাবে এটি সাজানো হয় তাহলে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো বর্তমান পরিস্থিতি স্বীকার করবে ও শ্রীলঙ্কাকে আরও বেশি অর্থ সাহায্য দেবে," বলেন তিনি।
শ্রীলঙ্কার ফেসবুক ও টুইটার-এ গত কয়েকদিন ধরে গো-হোম-রাজাপাকসে, এবং গটাগো-হোম হ্যাশট্যাগগুলো ট্রেন্ডিং-এ রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তীব্র সংকটে ভোগার পাশাপাশি বর্তমানে শ্রীলঙ্কার জনগণকে বিদ্যুৎ সংকট ও দ্রব্যমূল্যের তীব্র ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদিও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পরে আরেকবার এমন দূরাবস্থার মুখোমুখি হতে হলো দেশটিকে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কার পক্ষে বর্তমানে এর বিশাল ৫১ বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
দেশটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থা (আইএমএফ)-এর সঙ্গে তহবিলের জন্য আলোচনা চালাচ্ছে।