তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়া: বিশ্বস্ত ডিজিটাল ঘটক!
ক্যারিয়ারে সফল মাহাবুব আলম চাকরি করছেন একটি নামকরা প্রাইভেট কোম্পানিতে। কিন্তু ভবিষ্যৎ গড়ার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে বিয়েটাই আর করা হয়ে ওঠেনি তার। মাঝে মাঝেই ভাবতেন জীবনে চলার পথে একজন সঙ্গী থাকলে মন্দ হতো না। কিন্তু জীবন তো সিনেমার মতো না, যেখানে হরহামেশাই দেখা যায় চলতি পথে হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে প্রেম, সেখান থেকে বিয়ে ও তারপর সুখের সংসার।
তাই তো মাহাবুব নিজের আত্মীয় ও বন্ধুদের কাছে কেমন পাত্রী পছন্দ ও জীবনসঙ্গী হিসেবে কেমন মেয়ে চান, তা জানিয়ে রাখার পর দীর্ঘ ২ বছর কেটে গেলেও পছন্দমতো কোনো পাত্রীর সন্ধান তাকে কেউ দিতে পারেনি। এভাবে পাত্রী খুঁজতে খুঁজতে হতাশ মাহবুব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর বিয়েই করবেন না। কিন্তু কথায় আছে, 'জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে—তিন বিধাতা নিয়ে।' এভাবেই হঠাৎ একদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন সাইট ঘাঁটতে গিয়ে তার সামনে 'তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়ার' পেজটি চলে আসে। প্রথমে পেজটিকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে না পারলেও আগ্রহের জায়গা থেকে ভেতরে গিয়ে কয়েকজন পাত্রীর দিয়ে রাখা তথ্য দেখলেন। সেখানে মাহাবুব নিজের পছন্দমতো পাত্রীর তালিকা খুঁজে পেয়ে যোগাযোগ করেন। আর এভাবেই তিনি খুঁজে পান নিজের মনের মতো জীবনসঙ্গী এবং আজ তাদের সুখী দাম্পত্য জীবনের ২ বছর পূর্ণ হতে চলেছে।
কী চাই, পাত্র না পাত্রী?
'তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়ার' পেজে যোগাযোগ করলে প্রথমেই যে লেখাটি দেখা যায়, তা হলো পাত্র চাই/পাত্রী চাই! তারপর সেখান থেকে অটোমেটিক একটি লিংক আপনাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সেখানে ক্লিক করে ওয়েবসাইটে তথ্য লিপিবদ্ধ করা পাত্র/পাত্রীর সমস্ত তথ্য জানতে পারবেন। প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে নিজেও মেম্বার হতে পারবেন। বর্তমানে 'তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়া'তে সদস্য আবেদন ৭৩ হাজারের ওপরে থাকলেও সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে রেজিস্ট্রেশন করা হয় বলে পরিপূর্ণ ও নির্ভুল তথ্য দিয়েছেন এমন ব্যক্তিদের সদস্য নির্বাচন করা হয়েছে, যাদের সংখ্যা এখন ২৫ হাজার।
তাসলিমা আক্তার বলেন, 'আমাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যারা জীবনসঙ্গী খুঁজে নিয়েছেন তারা কখনো প্রতারিত হননি। বিয়ের পর অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় পাত্র/পাত্রীর দেওয়া তথ্য মিথ্যা ছিল এবং ঠকিয়েছে, তাই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন না ঘটে তার জন্য আমরা ৩ ধাপে সদস্যদের তথ্য যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকি। পাত্র/পাত্রীর নিজেদের তথ্য যাচাই থেকে শুরু করে পরিবার ও আত্মীয় সবার তথ্য নেওয়া হয় যথাযথ প্রমাণ ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহের মধ্য দিয়ে। তারপর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তবেই আমরা তাদেরকে সদস্য হওয়ার জন্য নির্বাচন করি। এই কাজটি করার জন্য আমাদের আলাদা লোকবল ও কর্মী রয়েছে। তাই আমি হলফ করে বলতে পারি মানুষের মনে ম্যারেজ মিডিয়া ও ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটগুলো নিয়ে কখনো কখনো সন্দেহের অবকাশ থাকলেও আমাদের থেকে সেবা নিয়েছেন এমন কেউ কখনো বলতে পারবেন না তারা ভুল তথ্য পেয়ে ঠকেছেন। আমরা আমাদের সব কাজ স্বচ্ছতা বজায় রেখে করার চেষ্টা করি। ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম হবে না।'
এত পেশা থাকতে ঘটক হলেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে 'তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়ার' প্রতিষ্ঠাতা তাসলিমা আক্তার বলেন, 'প্রফেশনাল জায়গা থেকে ঘটকের কাজ শুরুর অনেক আগে থেকেই আমার ঘটকালি করা হতো। পরিচিত ও আত্মীয়রা তাদের ছেলেমেয়ের জন্য ভালো পাত্র-পাত্রী আছে কি না খুঁজে দিতে বলত। এভাবে অন্যদের জীবনসঙ্গী খুঁজে দেওয়ার পর অনেকেই খুশি হয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানাত। সেখান থেকে উৎসাহ পেয়ে আমার মনে হলো ম্যারেজ মিডিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান খুললে কেমন হয়, যেখান থেকে আরও অনেকে তাদের জীবনসঙ্গী খুঁজে পাবেন!'
প্রথমদিকে নিজের আগ্রহ ও শখ থেকে ঘটকের পেশা শুরু করলেও বর্তমানে তাসলিমা আক্তার একজন সফল উদ্যোক্তা। বাংলাদেশের প্রথম কোনো সুসংগঠিত ম্যারেজ মিডিয়ার উদ্যাক্তা ও নারী ঘটক হিসেবে তার পরিচিতি অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি তাসলিমা আক্তার তার ভিন্ন এই উদ্যোগের স্বীকৃতিস্বরূপ 'সিটি আলো' পুরস্কার পেয়েছেন।
ঘটকদের সেইদিন ও এইদিন
'ঘটক' নামটি শুনলেই চিরাচরিত একটা দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে—বড় কালো ছাতা হাতে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিবাহযোগ্য পাত্র-পাত্রীর সন্ধান করছেন ঘটকেরা। গ্রামবাংলায় এখনো হাতেগোনা এমন কয়েকজন ঘটক দেখা গেলেও সময়ের সাথে সাথে এই পেশা ও এর সঙ্গে যুক্ত মানুষের মধ্যে আমূল পরিবর্তন চলে এসেছে। এখন আর পাত্র-পাত্রীর একে অপরকে দেখার জন্য কখন ঘটক মশাই ছবি নিয়ে হাজির হবেন তার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয় না। ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে সবকিছু এগিয়ে গেছে। তাই তো এখন যে-কেউ চাইলেই ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটগুলোতে গিয়ে নিজের পছন্দমতো জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পারেন। শুধু তাই নয়, সেখানে পাত্র/পাত্রীর তথ্য থেকে পরিবারের সমস্ত তথ্যই দেওয়া থাকে। তাই আর কষ্ট করে দীর্ঘ সময় ঘটকদের পেছনে ছুটতে হয় না, জনে জনে সবাইকে নিজের জন্য জীবনসঙ্গী খুঁজে দিতে বলতে হয় না।
'তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়া' অনলাইন ও অফলাইন দুধরনের সেবাই দিয়ে থাকে। সম্প্রতি 'তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়া' 'বিয়েশাদি ডট কম' নামের শুধুমাত্র অনলাইনভিত্তিক একটি ওয়েবসাইট নির্মাণের কাজ করছে, যেখান থেকে গ্রাহকরা তাদের সব কার্যক্রম অনলাইনে সম্পন্ন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে নিজেদের তথ্য অন্তর্ভুক্ত থেকে পাত্র-পাত্রীর ডেটা দেখা, যোগাযোগ ও লেনদেন সবকিছু হবে অনলাইনে। আবার কেউ চাইলে উত্তরায় অবস্থিত 'তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়ার' অফিসে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবেন। সময়ের অভাবে মানুষ অনেক কিছু করতে না পারলেও অনলাইনে কমবেশি সবারই পদচারণা থাকে—সে কথা মাথায় রেখে 'তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়ার' এই অনলাইনভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ।
২০১১ সালে প্রতিষ্ঠানটির সূচনালগ্নে প্রতিটি সদস্যের জন্য নির্ধারিত ফি ছিল ৫ হাজার টাকা। বর্তমানে সর্বনিম্ন মেম্বার ফি ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু হয়ে আরও বেশি। সাধারণ, প্রিমিয়ান সদস্যসেবা ইত্যাদি বিভিন্নভাগে ভাগ করে ফি নির্ধারণ করা হয়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি চুক্তিভিত্তিক কাজ করে থাকে যেখানে অর্থমূল্য ভিন্ন হয়। 'তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়া' থেকে জীবনসঙ্গী খুঁজে পাওয়ার পর সদস্যদের শর্তসাপেক্ষে বিয়ের পরে সর্বনিম্ন ৪০ হাজার টাকা প্রতিষ্ঠানকে দিতে হয়। এক্ষেত্রে টাকার অঙ্কের তারতম্য হতে পারে পাত্র ও পাত্রীর সামাজিক ও আর্থিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। 'তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়া' থেকে সেবাগ্রহীতাদের একটি বড় অংশ সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও উচ্চবিত্ত লোকজন। এদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ প্রবাসী বাঙালিরা। প্রতিষ্ঠানটি তাদের সেবা কার্যক্রম সাধারণ জনগোষ্ঠীর—আর্থিকভাবে যারা তেমন সচ্ছল না বা মধ্যবিত্তদের কাছে পৌঁছে দিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করতেও তারা নানারকম উদ্যোগ নিয়েছে। যার মধ্যে আছে গ্রামের ঘটকদের সাথে সমন্বয় করে তাদের এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে মানুষের কাছে ম্যারেজ মিডিয়ার সেবা পৌঁছে দেওয়া, যাতে মানুষ নিজ গন্ডির বাইরে গিয়ে নিজেদের জন্য জীবনসঙ্গী খুঁজে নিতে পারে। তাসলিমা আক্তারের আরেকটি শখ ছিল—সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করা। সেই ইচ্ছা পূরণে নিজের ম্যারেজ মিডিয়া প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি প্রতি বছর প্রতিবন্ধী ও হাফেজদের জন্য সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় বিয়ের কার্যক্রম করে থাকেন।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সাথে যুক্ত আছেন ৩০ জন কর্মী। এদের মধ্যে ৫ জন ম্যাচমেকার ও ২ জন ম্যারেজ কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। বাকিরা অনলাইন ফোন সেবাসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের প্রয়োজন অনুসারে বিয়ে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও ধারণার পাশাপাশি কাউন্সেলিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে এবং গ্রাহকদের সেবা নিশ্চিতে ২৪ ঘণ্টা তাদের অনলাইন ও ফোন সার্ভিস চালু থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বিয়ের সিদ্ধান্তকে সহজ করে দিতে সম্প্রতি 'তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়া' দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পেইন শুরু করেছে।
জীবনসঙ্গীর সাথে পাবেন পুরো প্যাকেজ
'তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়া' বিয়ে ও জীবনসঙ্গী খুঁজে পেতে সমন্বয়কারী ও মাধ্যম হিসেবে কাজ করলেও গ্রাহকদের তারা আরও কিছু বাড়তি সেবা দিয়ে থাকে। বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে শুরু করে সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত সবকিছু পাওয়া যাবে এখানে। প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার রিয়াদ মোরশেদ জানান, "আমাদের প্রতিষ্ঠানের মূল নীতি হচ্ছে আমরা সবার কাছে বিয়েকে সহজ করে দিতে চাই। অনেকে বিয়ের কথা শুনলে ভাবেন, এরচেয়ে জটিল কঠিন কাজ আর হতে পারে না। কিন্তু আমরা তাদেরকে বলতে চাই, বিয়ের চেয়ে সহজ, সুন্দর আর কিছু হতে পারে না। আমরা গ্রাহকদের জীবনসঙ্গী খুঁজে দেওয়ার পাশাপাশি বিয়ের জন্য পোশাক, ক্যাটারিং ও ডেকোরেটর সবকিছুর সন্ধান দিয়ে থাকি। বিয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব পাবেন তারা এখানে, যেটাকে আমরা প্যাকেজ বলি। আমাদের গ্রাহকরা এই সেবাগুলো পাবেন ডিসকাউন্টে, এইজন্য ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আমাদের চুক্তি করা আছে। ভবিষ্যতে 'তাসলিমা মিডিয়ার' পরিকল্পনা হচ্ছে আমাদের প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট চালু করা, যা আমাদের অনলাইন ওয়েবসাইট নির্মাণের পরবর্তী কাজ হবে।'
তাসলিমা আক্তারের লক্ষ্য তার প্রতিষ্ঠানকে এত দূরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যাতে ডিজিটাল ঘটক ও বাংলাদেশে ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইট বলতে সবাই একনামে 'তাসলিমা ম্যারেজ মিডিয়া'কে চেনে।