বেড়েই চলেছে পশুখাদ্যের দাম, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে দুগ্ধ খামারিরা
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ এলাকার খাজা ডেইরি ফার্মের খামারি মাহবুবুল আলম গত ৫ বছর ধরে গরুর খামার পরিচালনা করছেন । ২০টি গাভি থেকে দিনে গড়ে ২০০ কেজির বেশি দুধ বিক্রি করে স্বচ্ছলতার সাথে চলছিল খামারটি।
কোভিড মহামারির কারণে দেড় বছরমতো খামারে লোকসান দিতে হলেও গত ছয় মাস ধরে লাভের ধারায় ফিরেছিল তা। কিন্তু পশুখাদ্যের টানা দাম বৃদ্ধিতে আবারো সংকটে পড়েছেন তরুণ উদ্যোক্তা মাহবুবুল আলম। উৎপাদন খরচের চেয়েও দুধের দাম কম হওয়ায় খামার বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম হয়েছে তার।
একই অবস্থা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের খামারিদের। দেশিয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পশুখাদ্য সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে সারাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণির খামারিরা সংকটে দিন পার করছে। পশুখাদ্যের দাম বাড়লেও দুধের দাম আশানুরূপ বৃদ্ধি না পাওয়ায় খামারগুলোর বড় ধরনের লোকসান হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
ডেইরি খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ক্রমাগত বেড়েই চলেছে পশুখাদ্যের দাম। গত তিন মাসে বাজারে পশুখাদ্যের প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। খাদ্যের দাম বৃদ্ধিতে দুধের দামের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা। তবে আর্ন্তজাতিক বাজারে পশুখাদ্য সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে পশুখাদ্যের দাম বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের একাধিক খামারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি লিটার দুধ পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি করা হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। প্রতিদিন একটি গাভীকে যে পরিমাণ খাদ্য খাওয়ানো হয়, তার হিসাবে প্রতি লিটার গরুর দুধ বিক্রিতে খামারিতে তেমন একটা লাভ থাকছে না।
কিন্তু গত তিন মাসে দেশের বাজারে পশুখাদ্যের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা। ওষুধসহ খামার পরিচালনায় বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়ে গেলেও দুধের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় পরিচালন ব্যয় নিয়ে সংকটে পড়েছে খামারিরা।
চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা এলাকার মোল্লা ডেইরির সত্ত্বাধিকারী মো. হানিফ বলেন, "দিন দিন যেভাবে পশুখাদ্য ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ফার্ম করা কঠিন হয়ে পড়েছে। খাদ্য, ওষুধ ও শ্রমিকের মজুরি দিয়ে বর্তমানে প্রতি লিটার দুধ উৎপাদনে খরচ পড়ছে প্রায় ৬৪-৬৫ টাকা। কিন্তু বাজারে পাইকারি পর্যায়ে প্রতিকেজি দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে ৬০ টাকার মধ্যে।"
ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে প্রতিবস্তা (৫০ কেজি) সয়াবিন খৈল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ টাকায়। তিন মাস আগে সয়াবিন খৈলের দাম ছিল মাত্র ২ হাজার ৪০০ টাকা। তিন মাসে সয়াবিন খৈলের দাম বেড়েছে বস্তায় ৮০০ টাকা। আগে প্রতিবস্তা গমের ভুষির দাম ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা। বস্তায় ৩৫০ টাকা বেড়ে তা এখন বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫৫০ টাকায়।
তিন মাসে বস্তায় ৩০০ টাকা বেড়ে আটা কুড়া (রাইস পলিশ) বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকা। ৩৮০ টাকা বেড়ে এখন প্রতিবস্তা (৩০কেজি) মসুরের ভুষি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকা। প্রতি বস্তায় (৬০কেজি) ৬০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে এখন প্রতি বস্তা সরিষার খৈল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৯০০ টাকা।
একইভাবে প্রতিবস্তা (৫০ কেজি) ভুট্টার গুঁড়াতে ৫৩০ টাকা বেড়ে বর্তমানে ১ হাজার ৮৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। প্রতি বস্তা (৪০ কেজি) মুগ ডালের গুঁড়া ৩৮০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮২০ টাকা। প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) ১২০ টাকা বেড়ে মটর ভুষি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকা দামে।
দেশিয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে গম, ধান ও ডালের দাম বৃদ্ধির কারণে পশুখাদ্যের বাজারে নতুন অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
চিটাগাং ডেইরি ফার্ম এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মালিক মো. ওমর বাবু বলেন, "পশুখাদ্যের দাম এতই বেড়েছে যে, মূল খাদ্যপণ্যের চেয়ে ভুষির দাম বেড়ে গেছে। দিন দিন পশু খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় চরম বেকায়দায় পড়েছেন খামারিরা। কোভিড পরবর্তী ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে আবারো লোকসানে পড়েছে খামারীরা।"
এভাবে চলতে থাকলে লোকসানে যেকোন সময় খামার বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, "পশুখাদ্য উৎপাদন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।"
খাতুনগঞ্জের পাইকারি ডেইরি-পোলট্রি খাদ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স জয়নাব ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মোজাম্মেল হক বলেন, "প্রতিমাসেই পশুখাদ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। মিল পর্যায় থেকেউৎপাদন খরচ বৃদ্ধির অযুহাতে দাম বাড়ানোর ফলে পাইকারি পর্যায়েও বাড়তি দামে তা বিক্রি করা হচ্ছে। তাছাড়া বর্তমানে আমদানিকৃত পশুখাদ্যের সরবরাহ কিছুটা কমে যাওয়ায় বাজারে কৃত্রিম সংকট ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
পশুখাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, কোভিড পরবর্তী আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এমনকি কিছু কিছু পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
এরমধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দামে প্রভাব পড়েছে। রয়েছে জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি ও ডলারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব। যেহেতু খাদ্য পণ্য থেকেই পশুখাদ্য তৈরি হয় ফলে খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে দেশিয় বাজারে সব ধরনের পশুখাদ্যের দাম বেড়েছে।
এগ্রোটেক পোলট্রি অ্যান্ড অ্যানিমেল ফুডের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মো. শাহজালাল জানান, গতবছর দেশিয় বাজারে প্রতিকেজি ভুট্টা বিক্রি হতো ১৫-১৬ টাকায়। যা এখন ৩২ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে গত বছর আমদানিকৃত সয়াবিনের ভুষির দাম ছিল ৩৫ টাকা। বর্তমানে ৬২ টাকায় আমদানি করতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ১৬-১৭ টাকার প্রতিকেজি কুড়া কিনতে হচ্ছে ৩০ টাকায়। ৭০-৮০ টাকা মূল্যের খোলা সয়াবিন তেল এখন কিনতে হচ্ছে ১৬০-১৭০ টাকায়। ২০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে মেডিসিনের কাঁচামালের দামও।