‘পাড়ার ছোট্ট পার্ক, ঘাস নেই আছে ধুলো’
'পাড়ার ছোট্ট পার্ক, ঘাস নেই আছে ধুলো
ঘাসের অভাব পরোয়া করেনা সবুজ বাচ্চাগুলো।'
লিখেছেন ও গেয়েছেন নব্বইয়ের দশকে দুই বাংলা কাঁপানো গায়ক কবীর সুমন। অথবা বাংলা জীবনমুখী গানের আর এক রূপকার অঞ্জন দত্তের 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' গানেও কালিম্পংয়ের নীলচে পাহাড়ের দেশ থেকে আসা নেপালী ছেলেটি কলকাতার পার্কে এসে ভাসমান মানুষ হিসেবে আশ্রয় নেয়- পুলিশ তাকে নিয়ে যায় হাজতে। আমাদের এই চির দুঃখী, চির দরিদ্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় মানুষের গড় আয়, স্বাস্থ্য, পুষ্টিগত মান, শিক্ষা থেকে নগরীর পার্কে শিশুদের খেলা ও বিনোদনের জন্য পার্কগুলোর করুণ হালও যেন একইরকম।
সুমনের পার্ক নিয়ে গানটির প্রথম দু'লাইনে বলা হচ্ছে 'রেলিঙে শুকোয় শাড়ি, পাঁচিলে শুকোয় ঘুঁটে/ ঘাসগুলো সব শুকিয়ে শুকিয়ে শেষমেষ গেছে উঠে। এ তো ধানমন্ডি-৩২ এর আশপাশ দিয়ে যাবার সময় কলাবাগান পার্কের কথাই যেন বলা হচ্ছে। বিশেষত 'লোহার গেটের পাশে উনুন ধরায় কারা/রেলিং ঘেষেই সংসার করে কজন বাস্তুহারা।' হ্যাঁ, কলাবাগান পার্কের সামনে ফুটপাথে উনুন ধরিয়ে সংসার করা কিছু পরিবার আসা যাওয়ার পথে প্রায়ই তো দেখি। এমন ভাঙ্গাচোরা, ঘাসহীন এতটুকু পার্ক বা খেলার মাঠও কিন্তু দেখতে দেখতে বিরল হয়ে উঠছে আজকের ঢাকা শহরে।
হ্যাঁ, আমি সৈয়দা রত্না ও তাঁর সতেরো বছরের পুত্র প্রিয়াংশুর কথাই বলছি। মাত্র অল্প ক'দিন আগেই সংখ্যালঘু শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার রত্না নতুন করে মুখর হয়ে উঠেছিলেন কলাবাগানের তেঁতুলতলা খেলার মাঠটি রক্ষার জন্য। নিজে মীরপুরের পল্লবীতে সবুজের সান্নিধ্য ও খোলা পরিসরে বড় হয়ে ওঠা রত্না একজন প্রকৃত শিক্ষিত মা হিসেবে অবশ্যই জানেন যে কম্পিউটার ও টিভির সামনে অষ্টপ্রহর চিপস-ফাস্টফুড-কোক নির্ভর শিশুদের প্রতিমূহুর্তে দৃষ্টি-শ্রবণ-কর্ণ প্রতিবন্ধকতার মত সমস্যার মুখোমুখি করার পাশাপাশি একটি প্রজন্মকে আমরা স্থূল, দৈহিক পরিশ্রমের অভ্যাস তথা সামগ্রিক ফিটনেসহীন করে তুলেছি।
এই কায়িক অলসতা বা নিষ্ক্রিয়তা এবং প্রকৃতির অবারিত সবুজের সাথে সংযোগহীনতা মানুষ হিসেবে আমাদের শিশু-কিশোরদের ভেতরকার কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতাকেও বিকশিত হতে দিচ্ছে কি? আজ ঘরে ঘরে শিশুদের দাঁতের রোগ ও চোখের সমস্যা। একটু খেলার মাঠ নেই, একটু সবুজ নেই আশপাশে। খেলার মাঠে অন্য অনেক শিশুর সাথে চেঁচামেচি, আনন্দ এবং এমনকি মারামারির মাধ্যমেও যে স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিকায়ন হয় এবং 'আবেগগত বুদ্ধিমত্তা' বা 'ইমোশন্যাল ইন্টেলিজেন্সের' যে বিকাশ ঘটে তা পরে পরিণত বয়সে একজন মানুষকে কর্মক্ষেত্রসহ জীবনের নানা ক্ষেত্রেই নানা বিরূপ ও সহিংস পরিবেশেও টিকে থাকতে সাহায্য করে।
এদেশের একজন সচেতন নাগরিক ও সাহসী মা হিসেবে সৈয়দা রত্না ও তাঁর ছেলে প্রিয়াংশু তাই এগিয়ে এসেছিলেন। বিনিময়ে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে গতকাল হাজতে নিয়ে গেলেও নেটিজেনদের তীব্র প্রতিবাদে দ্রুতই তাঁরা মুক্তি পান। তবে 'ভবিষ্যতে তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে আর কোনো আন্দোলন না করার শর্তে এই মুক্তি মেলে। আমরা কি কল্পনা করতে পারছি যে রাষ্ট্র হিসেবে, নাগরিক সমাজ হিসেবে আমরা কোথায় অগ্রসর হচ্ছি? রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রবল কর্তৃত্ববাদীতা আমাদের কোন স্বখাত সলিলে নিয়ে যাচ্ছে?
গতকালের এই ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে ১৯৫২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার 'ইকিরু' সিনেমাটির কথা। ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত লেভ তলস্তয়ের 'দ্য ডেথ অফ ইভান ইলিচ' নামে উপন্যাসিকার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে কুরোসাওয়া এই সিনেমাটি বানান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানে তখনো আমাদের মতো দেশগুলোয় প্রচলিত আমলাতন্ত্রের মত অকার্যকরী, অলস ও নিষ্ঠুর একটি ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
এমন এক সিস্টেমেই পৌর ভবনে ত্রিশ বছরের মত দীর্ঘ সময় চাকরি করেছেন কাঞ্জি ওয়াতানাবে। যৌবনেই স্ত্রী বিয়োগ হবার পরও শিশু পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে কাঞ্জি আর দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করেননি। কিছুদিন ধরে অসুস্থ বোধ করায় কাঞ্জি একদিন গেলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার তাঁকে জানিয়ে দিলেন যে তিনি মরণব্যাধি কর্কটে আক্রান্ত এবং ছ'মাসের বেশি বাঁচবেন না। অবসন্ন কাঞ্জি বাসায় ফিরে শুনতে পান পুত্র ও পুত্রবধূর কলহ। বৃদ্ধ শ্বশুরের উপস্থিতিই পুত্রবধূর মনোবেদনার কারণ।
শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয়ে অবসন্ন কাঞ্জিকে তখন মন্দ বুদ্ধি দিতে এগিয়ে আসে কেউ কেউ। সারাজীবন এত সংযম চর্চা করে কী হবে? সে ত' জীবনটা উপভোগই করেনি। কেন নয় মদ্য পান বা নৃত্য-গীতে পারদর্শী, সুন্দরী গেইশাদের সঙ্গ লাভ? একদিন গেইশা বাড়ি গিয়ে ও মদ্য পান করেও কাঞ্জি বুঝতে পারেন এটা তাঁর পথ নয়। ঠিক কী করলে জীবনের বাকি ছ'মাস তিনি অর্থপূর্ণ করতে পারেন? এসময়ই তাঁর কাছে চাকরি ছেড়ে দেবার আবেদন পত্র নিয়ে আসে তাঁর এক তরুণী অধঃস্থন টয়ো। টয়ো এই আমলাতান্ত্রিক কাজ ভালবাসে না। বর্তমানে সে বাচ্চাদের জন্য খেলনা বানাচ্ছে আর গভীর আনন্দ পাচ্ছে এই কাজে।
কাঞ্জির মনে পড়লো গত ত্রিশটি বছর ধরে শহরের মায়েরা বাচ্চাদের জন্য একটি খেলার পার্ক বানানোর জন্য কত আকুল আবেদনই না জানিয়েছে আর পৌরভবন অফিস এক মন্ত্রণালয় থেকে অন্য মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠিয়ে ত্রিশ বছরেও পার্কটি হতে দেয়নি। এবার শুরু হলো কাঞ্জির ক্রুসেড।
কর্কটরোগে আক্রান্ত ও তরুণী অধঃস্থনের সাথে একদিন মাত্র একটি ক্যাফেতে দেখা হওয়ায়, পুত্র-পুত্রবধূর কাছে অপমানিত ও বাড়ি থেকে বিতাড়িত কাঞ্জি একাই লড়াই শুরু করেন নগর ভবনের আমলাতন্ত্রের সাথে। তাঁর সাথে যোগ দেয় নগরীর সাধারণ বাবা-মায়েরা। ছ'মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সদ্য নির্মিত পার্ক যেদিন উদ্বোধন হবে, তার আগের রাতে তীব্র তুষারঝড়ে পার্কের বেঞ্চিতে মরে পড়ে থাকেন কাঞ্জি।
জানি না আমাদের দেশের প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র কখনো কুরোসাওয়ার ছবির মত বদলে যাবে কিনা? সৈয়দা রত্নার মত জননী সাহসিকারা কাঞ্জি ওয়াতানাবের মত সেই বদলের রূপকার হয়ে উঠবেন- এমন আশা হয়তো খুব অমূলক নয়।