আফগানিস্তানের জন্য কেনা রাশিয়ান হেলিকপ্টার এখন ব্যবহার হচ্ছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে
২০১০-এর দশকের প্রথমদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান সরকারের জন্য কিছু হেলিকপ্টার কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী পরে তারা রাশিয়ার রাষ্ট্রায়াত্ত একটি কোম্পানি থেকে এমআই-১৭ মডেলের হেলিকপ্টার কেনে।
এ সিদ্ধান্তের ফলে তখন অনেক মার্কিন আইনপ্রণেতা নখোশ হন। তারা মনে করলেন পেন্টাগনের উচিত ছিল আমেরিকান কোনো কোম্পানি থেকে হেলিকপ্টার কেনা। কিন্তু মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের যুক্তি ছিল রাশিয়ার তৈরি হেলিকপ্টারগুলো দামে কম, এগুলো আফগানিস্তানের মরুভূমির পরিবেশের জন্য দারুণ উপযোগী, এবং আফগান পাইলটেরা এ মডেলের হেলিকপ্টারগুলো চালাতে জানেন।
এক দশক পরে এ রাশিয়ান হেলিকপ্টারগুলো রাশিয়ানদের বিরুদ্ধেই যে ব্যবহার করা হবে সেটা হলপ করে বলা যায়, সে সময় ক্রেমলিন বা মার্কিন কংগ্রেস কেউই ধারণা করতে পারেনি।
গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কিয়েভের জন্য অনুমোদন করা তার ৮০০ মিলিয়ন ডলারের নতুন নিরাপত্তা প্যাকেজ নিয়ে কথা বলার সময় হেলিকপ্টারগুলোর অস্বাভাবিক এ ভ্রমণ ইতিহাস নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করেননি।
এই ১১টি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার ঠিক এমন একটা সময় ইউক্রেনকে দেওয়া হচ্ছে যখন রাশিয়ার সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পড়েছে দেশটির পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চল। এমআই-১৭ হেলিকপ্টারগুলো মূলত সৈন্যপরিবাহী কপ্টার হিসেবে কাজ করলেও এগুলোতে কামান ও রকেট যুক্ত করা যায় সহজেই। এর ফলে এই সাধারণ হেলিকপ্টারগুলোও কিছুটা অ্যাটাক হেলিকপ্টারের ভূমিকা পালন করতে পারে এবং প্রয়োজনে ভূমিতে থাকা পদাতিক সৈন্যদলকে ক্লোজ এয়ার সাপোর্ট প্রদান করতে পারে।
গত সপ্তাহে বাইডেনের সাথে এক ফোনকলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ওই হেলিকপ্টারগুলো দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। তার প্রেক্ষিতে শেষ মুহূর্তে এসে ওই হেলিকপ্টারগুলোকে নিরাপত্তা প্যাকেজের সাথে যোগ করা হয়।
ফরেনইন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর একজন জ্যেষ্ঠ ফেলো ও রাশিয়ার নিরাপত্তানীতি বিশেষজ্ঞ রব লি বলেন, 'ইউক্রেন এ হেলিকপ্টারগুলো দিয়ে সেনা পরিবহন করতে পারে। এছাড়া এগুলো বিশেষ অভিযান পরিচালনা, আহতদের রণক্ষেত্র থেকে সরানো, রসদ ও গোলাবারুদ পরিবহন, রাশিয়ান সেনাদল ও অবকাঠামোর ওপর হামলা ইত্যাদি কাজেও ব্যবহার করতে পারে দেশটি।'
ইউক্রেন যত বেশি হেলিকপ্টার পাবে, তত বেশি আক্রমণাত্মক হতে পারবে বলেও মন্তব্য করেন এ বিশেষজ্ঞ।
পেন্টাগনের একজন মুখপাত্র ক্যাপ্টেন মাইক কাফকা জানিয়েছেন ইউক্রেনকে সর্বমোট ১৬টি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার দিতে রাজি হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে যখন তালেবান আফগানিস্তানের সরকারের পতন ঘটায় ও কয়েক বিলিয়ন ডলারে পশ্চিমা অস্ত্র দখল করে নেয়, তখন আফগানিস্তানের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তির অধীনে হেলিকপ্টারগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছিল।
ওই সময় ওই হেলিকপ্টারগুলো আফগান সরকারের মালিকানায় ছিল। কিন্তু এগুলো আফগান সিকিউরিটি ফোর্সেস ফান্ড-এর অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের অর্থে কেনা, তাই পেন্টাগন ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে এ হেলিকপ্টারগুলোকে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করার জন্য কংগ্রেসের কাছে প্রস্তাব পাঠায়।
এরপর প্রেসিডেন্ট বাইডেন যখন হেলিকপ্টারগুলো ইউক্রেনকে দিয়ে দিতে সম্মতি দেন, তখন নতুন একটি চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। কীভাবে এগুলোকে ইউক্রেনে পাঠানো হবে সে চ্যালেঞ্জ।
ইউক্রেনে রাশিয়ান আক্রমণের সময় পাঁচটি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইউক্রেনেই ছিল। এতে অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ সোভিয়েত আমলে বানানো এ হেলিকপ্টারগুলোর বিষয়ে ইউক্রেনের ইঞ্জিনিয়ারদের যথেষ্ট ধারণা আছে। আর্মস এক্সপোর্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট-এর অধীনে ওই পাঁচটি হেলিকপ্টারকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করে যুক্তরাষ্ট্র।
বাকি ১১টি হেলিকপ্টার বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিস-মন্থান বিমানঘাঁটিতে রাখা আছে। এ সপ্তাহের শেষ নাগাদ এগুলোকে ইউক্রেনে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে পেন্টাগন। অবশ্য ঠিক কবে ইউক্রেনে পৌঁছাবে কপ্টারগুলো, তার পেছনে আবহাওয়াসহ অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করবে।
এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র পাঠিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ ব্যাপারে সম্প্রতি প্রতিবাদ জানিয়েছে মস্কো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এভাবে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ না করতে সতর্ক করে দিয়েছে মস্কো, অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্রকে 'অপ্রত্যাশিত দুর্ভোগে' পড়তে হবে বলেও জানিয়েছে ক্রেমলিন।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বুধবার বলেছেন, পেন্টাগনের এই হেলিকপ্টার দানকে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখা উচিত ইউক্রেনের। মারিয়া জাকানরোভা বলেন, 'ইউক্রেনকে যে হেলিকপ্টার পেন্টাগন দিচ্ছে সেগুলো একসময় আফগানিস্তানের জন্য কিনেছিল তারা। আর এ আফগানিস্তানকে ভরাডুবি অবস্থায় ফেলে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।' তিনি প্রশ্ন রাখেন, 'ইউক্রেনকেও কি আফগানিস্তানের দুর্ভাগ্য অবলম্বন করতে হবে? ওই হেলিকপ্টারগুলোর ক্ষেত্রে তা ঘটেছে। এ দিক থেকে মার্কিন রাজনীতিকেরা নিজদের প্রতিশ্রুতির কথা ফেলেন না। নিজেদের নিকটতম মিত্রের সাথে বেইমানি আমেরিকার রাজনৈতিক রক্তের অংশ হয়ে গিয়েছে।'
ওদিকে ইউক্রেনের কর্মকর্তারা নতুন নিরাপত্তা প্যাকেজের জন্য ওয়াশিংটনের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। একইসাথে তারা আরও অস্ত্র দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে মার্কিনীদের কাছে।
'ইউক্রেনকে সাহায্য ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন যোগাতে কাজ করার মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন একজন প্রকৃত নেতার নেতৃত্বগুণ প্রদর্শন করেছেন,' সম্প্রতি এমনটই মন্তব্য করেছেন ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা।
তবে ইউক্রেনে মস্কোর বিরুদ্ধে রাশিয়ান হেলিকপ্টার ব্যবহারের ব্যাপারটি পরিহাসের মতো শোনালেও সামরিক বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন, আফগানিস্তানের চেয়ে ইউক্রেনে বেশি কার্যকরীভাবে এমআই-১৭ কপ্টারগুলো ব্যবহার করা যাবে।
ইউক্রেন একটি সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা চিনুক ও ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারের চেয়ে ইউক্রেনের বাহিনীর রাশিয়ান হেলিকপ্টার ব্যবহারের বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা একজন সাবেক মার্কিন সেনা কর্মকর্তা জেসন ডেম্পসি।
ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ তাদের কাছে থাকা সোভিয়েত যুগের তৈরি করা কিছু অস্ত্র ইউক্রেনকে দিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। এর মধ্যে স্লোভাকিয়া তাদের কাছে থাকা রাশিয়ার তৈরি এস-৩০০ বিমানবিধ্বংসী মিসাইল ইউক্রেনকে দিতে রাজি হয়েছে। অবশ্য এর পেছনে ওয়াশিংটনের অবদান রয়েছে। কারণ এ মিসাইলগুলো ইউক্রেনকে দিয়ে দিলে তার বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরিকৃত আরও উন্নত প্যাট্রিয়ট মিসাইলের সমসংখ্যক ব্যাটারি পাবে দেশটি।
এছাড়া পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্র রাশিয়ার তৈরি টি-৭২ মেইন ব্যাটল ট্যাংক পাঠিয়েছে ইউক্রেনে। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশনস-এর গবেষণা পরিচালক জেরেমি শাপিরো বলেন, 'রাশিয়ানরা তাদের সস্তা অথচ নির্ভরযোগ্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পুরো বিশ্ব ছেয়ে ফেলেছে। সে কারণেই এ যুদ্ধে দুপক্ষই সমানভাবে পাল্লা দিতে পারছে।'
অবশ্য একই ঘটনা যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ঘটেনি তা নয়। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অস্ত্র রপ্তানিকারকদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দেশ। এ দেশটি প্রায়ই এমন সব বিপক্ষশক্তির সাথে যু্দ্ধের ময়দানে লড়েছে, যারা মার্কিন অস্ত্রে সুসজ্জিত ছিল।
টিল গ্রুপ কনসাল্টেন্সির একজন জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক জেজে গার্টলার বলেন, 'যখন আপনি কাউকে একটি হাতুড়ি বিক্রি করেন, আপনি কিন্তু জানেন না ওই হাতুড়ি কি ঘর বানাতে ব্যবহার করা হবে নাকি আপনার জানালার কাচ ভাঙতে।'
সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট