ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ, এলএনজি নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে
গতকাল পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। গ্যাসের দাম রুবলে পরিশোধ করার রাশিয়ার দাবি প্রত্যাখান করায় দেশ দুটিতে গ্যাসের চাবি বন্ধ করল ক্রেমলিন। ইউক্রেন-সংকট প্রসঙ্গে পশ্চিমাদের উদ্দেশে এটাই এখন পর্যন্ত রাশিয়ার সবচেয়ে কঠিন বার্তা। ইউরোপের এ জ্বালানি সংকটের ধাক্কা লাগবে বৈশ্বিক তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) বাজারে।
এ ঘটনা বাংলাদেশের জন্যও দুঃসংবাদ। বাংলাদেশ কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এলএনজি উৎপাদনকারী তিন দেশের একটি কাতার।
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এলএনজিকে ব্যয়বহুল অথচ প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আপাত পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে, এলএনজির দাম সামনে আরও বাড়বে। সেইসঙ্গে এর সহজলভ্যতাও আগের চেয়ে কমে যাবে।
রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প হিসেবে কাতারের কাছে ধরনা দিতে শুরু করেছিল ইউরোপের দেশগুলো। রয়টার্স-এর খবর অনুযায়ী, কাতার জানিয়েছিল তার পক্ষে রাশিয়ার সরবরাহকৃত গ্যাসের সমপরিমাণ গ্যাস ইউরোপকে দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে দেশটি তার বর্তমান এলএনজি সরবরাহের সর্বোচ্চ ১০ থেকে ২০ শতাংশ ইউরোপকে দিতে পারবে বলেও জানায়।
বৈশ্বিক এলএনজি উৎপাদনে শীর্ষস্থানে থাকা অন্য দুটি দেশ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া। তবে এ দুটি দেশও ইউরোপের বাজারে রাশিয়ান গ্যাসের প্রতিস্থাপক হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেনি। কারণ, এ দেশগুলো ইতোমধ্যে তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় এলএনজি উৎপাদন করছে। আর তাদের বেশিরভাগ গ্যাসই দীর্ঘকালীন চুক্তির আওতায় রপ্তানি করা হচ্ছে।
তবে বিশ্ববাজারে হঠাৎ এলএনজির চাহিদা এভাবে বেড়ে যাওয়ায় কাতারএনার্জি তাদের এলএনজি উৎপাদন বাড়ানোর দিকটিও বিবেচনা করছে। দেশটির নর্থ ফিল্ড-র সক্ষমতা বাড়ানোর প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে বার্ষিক এলএনজি উৎপাদন আগামী ২০২৭ সালের মধ্যে ৭৭ মিলিয়ন টন থেকে ১২৬ মিলিয়ন টনে উন্নীত করার কথা রয়েছে। তবে বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কাতারএনার্জি এ সক্ষমতা আরও বাড়ানোর কথা ভাবছে।
তার আগ পর্যন্ত বিশ্বে এলএনজি বাজারে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হবে। আর সেজন্য দামও চড়বে এ জ্বালানি উপাদানটির।
ইউরোপের বাইরে এলএনজির বড় ভোক্তা হলো এশিয়া। বিশেষত চীন ও জাপান বিশাল পরিমাণে এলএনজি আমদানি করে। আর ভারতীয় উপমহাদেশও ক্রমশ এলএনজির বড় ক্রেতায় পরিণত হচ্ছে।
ইকোনমিস্ট-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে চীনের এলএনজি আমদানি ৮২ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় এলএনজি আমদানিকারক হিসেবে জাপানকে পেছনে ফেলেছে।
বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ এলএনজি ১০ বছর বা তার বেশি মেয়াদি চুক্তিতে রপ্তানি করা হয়। ইউরোপ সাধারণত এলএনজির জন্য স্পট মার্কেট ও ছোটখাটো চুক্তির উপর নির্ভরশীল। এ প্রক্রিয়ার কারণে অতীতে যথেষ্ট মজুদ থাকার সময় ইউরোপ কম দামে এলএনজি কিনতে পারার সুবিধা ভোগ করেছিল। অথচ একই কারণে এখন ইউরোপকে বাজারের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে চাহিদার কারণে কিছু এলএনজি অবশ্যই ইউরোপের দিকে সরবরাহ করা হবে। তবে এলএনজির বাজারে সরবরাহ সংকট দেখা দেবে, এবং অভূতপূর্ব গতিতে এর দাম বাড়বে।
কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ
কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের জন্য এলএনজি বিবেচিত হতো ব্যয়বহুল বিকল্প হিসেবে। কিন্তু গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়া ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে সরকার এই বিকল্পেরই আশ্রয় নেয়। ২০১৮ সাল থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি সরবরাহের জন্য ২০১৭ সালে কাতারের সঙ্গে ১৫ বছর মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করে সরকার। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ৮.৪২৪ মিলিয়ন টন এলএনজি কিনেছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ও পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্ল্যান (পিএসএমপি) ২০১৬-এর প্রাক্কলন অনুসারে, ২০৪১ সাল নাগাদ দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের (এমএমসিএফ) নিচে নেমে আসবে। অথচ ওই সময় প্রতিদিন দেশের মোট গ্যাসের চাহিদা হবে প্রায় ৬ হাজার এমএমসিএফ।
তাই চাহিদা ও সরবরাহের এই ফাঁক এলএনজি আমদানির মাধ্যমেই পূরণ করতে হবে। পিএসএমপির পূর্বাভাস অনুসারে, মোট সরবরাহে এলএনজির অবদান ২০২৩ সালে ৪০ শতাংশ, ২০২৮ সালে ৫০ শতাংশ ও ২০৪১ সালে ৭০ শতাংশে উন্নীত হবে।
দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের গ্যাসের চাহিদা বাড়ার সুযোগ দেওয়া না হলেও চাহিদা মেটানোর মতো গ্যাসের মজুদ রয়েছে মাত্র ১০ বছরেরও কম সময়ের।
এ কারণে সরকার কাতারের সঙ্গে চুক্তি করে।
ভবিষ্যতে গ্যাস সরবরাহের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার বাংলাদেশে নিযুক্ত কাতারের নতুন রাষ্ট্রদূতকে চুক্তিটি দীর্ঘ মেয়াদে বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। দেশটির কাছে আরও এলএনজি চেয়েছে বাংলাদেশ।
ইতিমধ্যে কাতারকে বছরে আরও ১ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কাতার ও ডাচ জ্বালানি জায়ান্ট ভিটলের মধ্যে বাংলাদেশকে বার্ষিক ১.২৫ মিলিয়ন টন এলএনজি দেওয়ার জন্য একটি পৃথক চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাও এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ এলএনজি আমদানিকারক হওয়ার পথে হাঁটছে। কেবল ২০১৯ সালেই কাতারগ্যাস ও ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে পৃথক দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে ৩.৮৯ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানি করেছে বাংলাদেশ।
জ্বালানি খাতে এশিয়া কাতারের সবচেয়ে বড় বাজার।
এ বছরের জানুয়ারিতে কাতার থেকে ১.২ মিলিয়ন টনের বেশি এলএনজি আমদানি করে ভারত। এর মাধ্যমে কাতারের এলএনজির শীর্ষ গন্তব্য হয়ে ওঠে দেশটি। চীন প্রায় ১ মিলিয়ন টন, দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় ৬ লাখ ৬১ হাজার টন ও পাকিস্তান ৫ লাখ ৪ হাজার টন এলএনজি আমদানি করে ভারতের পরের অবস্থানে রয়েছে।
কাতার গত বছর ১১০ বিলিয়ন ঘনমিটার (বিসিএম) গ্যাস সরবরাহ করেছে।
ইউরোপের দুর্দশা
রয়টার্সের তথ্য অনুসারে, ইউরোপের মোট গ্যাস সরবরাহের ৪০ শতাংশই আসত মস্কো থেকে। যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ চালান যেত ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে। গত বছর ইউরোপে প্রায় ১৫৫ বিসিএম গ্যাস সরবরাহ করে রাশিয়া। এর মধ্যে ৫২ বিসিএম যায় ইউক্রেন বা কাছাকাছি রুট দিয়ে।
রাশিয়ার তেল ও অন্যান্য জ্বালানি আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ব্রিটেন বলেছে, তারা ২০২২ সাল নাগাদ রাশিয়ান জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে দেবে। ইইউ বলেছে, তারা এ বছর রাশিয়ার গ্যাস আমদানি দুই-তৃতীয়াংশ কমাতে চায়। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে রাশিয়ার গ্যাসের উপর নির্ভরতা থামাতে চায় বলেও জানিয়েছে ইইউ।
ইউরোপীয় কমিশন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের মতো দেশগুলো থেকে গ্যাস ও এলএনজি আমদানির মাধ্যমে রাশিয়ার সরবরাহের ৬০ বিসিএম প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।
গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন। এসবের মধ্যে রয়েছে জন্য থার্মোস্ট্যাট এক ডিগ্রি কমিয়ে চলতি বছর ১০ বিসিএম গ্যাস সাশ্রয় করা এবং আন্তঃসংযোগকারীর মাধ্যমে বিদ্যুৎ আমদানির দিকে ঝোঁকা।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা এ বছর ইইউতে ১৫ বিসিএম গ্যাস সরবরাহের জন্য কাজ করবে। তবে এই পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ আসলে কোথা থেকে আসবে, তা নিশ্চিত করেনি যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকান এলএনজি কারখানাগুলো ইতিমধ্যে পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপে পাঠানো বাড়তি মার্কিন গ্যাসের সিংহভাগই অন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসবে।
আরেক শীর্ষ এলএনজি উৎপাদনকারী অস্ট্রেলিয়া বলেছে, তার উৎপাদনের ৭৫ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে। ইউরোপকে এলএনজি সরবরাহ করতে হলে এ চুক্তি লঙ্ঘন করতে হবে বলে জানিয়েছে দেশটি।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন হামলার পর রাশিয়ার গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর চেষ্টায় কাতারের সঙ্গে যোগাযোগ করে অস্ট্রিয়া, ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স।
ওই সময় কাতার জোর দিয়ে বলে যে, ইউক্রেনে সম্ভাব্য রাশিয়ান আক্রমণের ক্ষেত্রে তারা ইউরোপে রাশিয়ার জ্বালানির বিকল্প হতে পারবে না। তবে এলএনজি চালানের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ইউরোপের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারবে বলে জানায় কাতার।