‘গোস্ট অফ কিয়েভ’: ইউক্রেনীয়দের সৃষ্টি এক কাল্পনিক সুপারহিরো চরিত্র মাত্র!
ইউক্রেনের ফাইটার পাইলটদের সংখ্যা রাশিয়ানদের তুলনায় হাতে গোনা মাত্র। কিন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধে এক ফাইটার পাইলটের কথিত বীরত্বের কাহিনী তাকে রীতিমত কিংবদন্তীতে পরিণত করেছে।
বলা হচ্ছে, 'গোস্ট অব কিয়েভ' নামক ইউক্রেনের এই পাইলট ৪০টির মতো শত্রু বিমানকে ভূপাতিত করেছেন। একজন ইউক্রেনীয়র জন্য এটি আদতেই অবিশ্বাস্য এক সাফল্য।
তবে সম্প্রতি ইউক্রেনের এয়ার ফোর্স কমান্ড ফেসবুকে সতর্ক করে বলে, 'গোস্ট অফ কিয়েভ' ইউক্রেনীয়দের সৃষ্টি একটি কাল্পনিক সুপারহিরো চরিত্র মাত্র।
কোনো তথ্য ছড়ানোর আগে তা যাচাই করে নেওয়ার জন্য দেশটির জনগণকে অনুরোধ করে ওই পোস্টে ইউক্রেনের বিমান বাহিনী লিখে, "আমরা ইউক্রেনীয়দের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি সঠিক তথ্য সংক্রান্ত মৌলিক নিয়মগুলোকে যেন তারা এড়িয়ে না যান।"
এ বিষয়ে এর আগে যেসব প্রতিবেদন ছাপানো হয় তাতে দাবি করা হয়, ২৯ বছর বয়সী মেজর স্টেপান টারাবল্কাই কথিত গোস্ট পাইলট। কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে যে, তিনি গত ১৩ মার্চ যুদ্ধে নিহত হন এবং মরণোত্তর বীরত্বের পদক 'হিরো অব ইউক্রেনে' ভূষিত হয়েছেন।
কিন্তু, দেশটির বিমান বাহিনী এখন জোর দিয়ে বলেছে, মেজর টারাবাল্কা গোস্ট অফ কিয়েভ নন, এবং তিনি ৪০টি বিমান ধ্বংসও করেননি।
বিমান বাহিনীর মতে, 'গোস্ট অফ কিয়েভ' আসলে তাদের ৪০তম ট্যাকটিকাল এভিয়েশন ব্রিগেডের পাইলটদের একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা। তারাই কিয়েভের আকাশকে সুরক্ষিত রাখছে, এটি কোনো একক ব্যক্তির বীরত্বগাথা নয়।
'গোস্ট অফ কিয়েভ' কে, তার নাম-পরিচয়, কিছুই জানতো না কেউ। কিন্তু এরপরেও তাকে ঘিরে নানা কাহিনী সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
এমনকি ইউক্রেনের একটি মডেল এয়ারক্রাফট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের বিক্রি বাড়ানোর জন্য গোস্ট অফ কিয়েভকে মার্কেটিং ব্র্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়া, ইউক্রেনিয়ান ইরিনা কোস্টিরিংকো এই কিংবদন্তি চরিত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত একটি সামরিক ব্যাজও প্রদর্শন করেন।
সেসময় দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় টারাবাল্কার বীরত্বকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি ভিডিও টুইট করে।
তবে, তখন থেকেই ভুতুড়ে পাইলটের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ জাগে অনেকের। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বিবিসিকে বলেন, একজন পাইলট ৪০টির মতো রাশিয়ান বিমান ভূপাতিত করতে কি না, সে বিষয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে।
অন্যদিকে, ইউক্রেনের সামরিক ইতিহাসবিদ মিখাইল ঝিরোহভ 'গোস্ট অফ কিয়েভ'কে দেশটির জনগণের মনোবল বাড়ানোর জন্য একধরনের প্রোপাগান্ডা বলে উল্লেখ করেন।
বিবিসির সাথে আলোচনার সময় তিনি বলেন, যুদ্ধের শুরু থেকেই রাশিয়ানরা ইউক্রেনের আকাশসীমায় আধিপত্য বিস্তার করে। এ অবস্থায় একজন ইউক্রেনীয় পাইলট বড়জোর ২ বা ৩টি বিমান হয়তো আক্রমণ করতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, "এরকম প্রোপাগান্ডার প্রয়োজন আছে। আমাদের সামরিক বাহিনী অনেক ছোট, এবং অনেকেই মনে করে আমরা রাশিয়ার সমকক্ষ নই। তাই যুদ্ধের সময় আমাদের এরকম কিছুর দরকার আছে," বলেন তিনি।
ইউক্রেনিয়ান পাইলটরা যেসব যুদ্ধবিমান চালান, সেগুলো রাশিয়ার তুলনায় বেশ কম ক্ষমতাসম্পন্ন। মূলত রুশ নির্মিত মিগ-২৯ বিমান দিয়েই তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে। এগুলো দিয়েই যে তারা আকাশ যুদ্ধে রাশিয়াকে এখনো ঠেকিয়ে রাখছেন, অনেকটা সে কারণেই 'গোস্ট অফ কিয়েভের' গল্প তৈরি হয়েছে।
রাশিয়া যদিও তাদের বিপুল সামরিক শক্তি নিয়ে গত দুই মাস ধরে ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করতে চেষ্টা করছে, এখনও তারা পুরোপুরি সফল হয়নি।
কিংবদন্তি এই পাইলটের গল্প ছড়াতে ইউক্রেনের কর্তৃপক্ষও সাহায্য করেছে। ইউক্রেনের সিকিউরিটি সার্ভিস টেলিগ্রাম মেসেজিং সার্ভিসে এক ফাইটার পাইলটের ছবি শেয়ার করে তারা, যার ক্যাপশন ছিল 'গোস্ট অফ কিয়েভ'। এতে দাবি করা হয় এই পাইলট দশটি রুশ যুদ্ধ বিমান ধ্বংস করেছেন। তবে সেই বার্তায় পাইলটের নাম বলা হয়নি। পরে মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হয়, ছবিটা আসলে পুরনো।
ইউক্রেনের এক সামরিক বিশেষজ্ঞ তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বিবিসিকে বলেন, 'গোস্ট অফ কিয়েভে'র গল্প তাদের সৈনিকদের মনোবল বাড়াতে সাহায্য করেছে।
যুদ্ধে ইউক্রেন এবং রাশিয়া কী পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়েছে, তার পরিসংখ্যানে রয়েছে বিরাট তারতম্য। ফলে এরকম কাল্পনিক গল্প তৈরি হওয়া অবাক করার মতো কিছু নয়।
এর আগে, গত ৩০ এপ্রিল ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী দাবি করে যে, রাশিয়া এই যুদ্ধে ১৯০টি বিমান এবং ১৫৫টি হেলিকপ্টার হারিয়েছে। কিন্তু, একটি স্বাধীন সামরিক বিশ্লেষক সংস্থা ওরিস্কের মতে, রাশিয়া ২৬টি বিমান, ৩৯ হেলিকপ্টার এবং ৪৮টি ড্রোন হারিয়েছে।
রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয়ই তাদের নিজেদের আসল ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে তথ্য গোপন রাখছে, কাজেই এর হিসাব রাখা কঠিন।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এক বিষয়ে একমত যে, বেশিরভাগ রুশ বিমানই ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, বিশেষ করে ম্যান-পোর্টেবল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম (ম্যানপ্যাড) দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে।
সিবিলিটি সিকিউরিটি কনসালটেন্সি সিবিলিনের জাস্টিন ক্রাম্প বলেন, সামাজিক মাধ্যমের যুগে 'গোস্ট অফ কিয়েভের' মতো কাহিনী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের মধ্যে সংহতির জন্য এরকম কল্পকাহিনী ও কিংবদন্তী দরকার।
- সূত্র- বিবিসি