গিলগামেশ থেকে বেজোস: মানুষের অমরত্ব লাভের দীর্ঘ বিভীষিকাময় প্রচেষ্টা
'মৃত্যু প্রতিমুহূর্তে আমাদের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে'- বলেছিলেন রেনেসাঁ যুগের দার্শনিক মন্টাইগেন। জীবনের পরিণতি মৃত্যু। আর সেই মৃত্যু কখন ঘটবে সেটাও পুরোপুরি অনিশ্চিত। কিন্তু মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে মানুষের পক্ষে কি কখনো চিরকাল বেঁচে থাকা সম্ভব হবে? এমন কোনো সঞ্জীবনী কি আদৌ আছে যা মানুষকে অমর করতে পারবে?
অমরত্বের বিষয়টি কল্পকাহিনী কিংবা মহাকাব্যের কোনো গল্প মনে হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞান যে অমরত্ব নিয়ে ভাবছে না এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। ২০১৩ সালে বায়োটেক ফার্ম ক্যালিকোর উদ্বোধন করে গুগল। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যই হলো মৃত্যুর 'সমাধান' বের করা। পেপ্যালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা পিটার থিয়েলও মৃত্যুর বিরুদ্ধে 'লড়াই' করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এমনকি গত বছর শোনা যায় আমাজনের চেয়ারম্যান জেফ বেজোসও অ্যাল্টোস ল্যাবস নামের একটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন যারা কোষ 'পুনরুজ্জীবিত' করা নিয়ে কাজ করবে।
কুকুরের আয়ুষ্কাল বাড়াতে সক্ষম একটি ওষুধ নিয়েও চলতি বছর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হবে। ট্রায়াল সফল হলে মানুষের জন্যও একই পদ্ধতি অনুসরণ করবে গবেষকরা।
অমরত্ব কিংবা বার্ধক্য ঠেকানো বিষয়ক গবেষণাকেই বিজ্ঞানের পরবর্তী বড় চমক বলে মনে করা হচ্ছে। ২০২৫ সাল নাগাদ এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৬১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা। সিলিকন ভ্যালি থেকে কেমব্রিজ এমনকি ইংল্যান্ড পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা যেন সেই অমৃতের সন্ধানই করে চলেছেন। সঞ্জীবনী অনুসন্ধানের দীর্ঘ ইতিহাসে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নিত্যনতুন পাতা।
মানবসভ্যতার প্রাচীনতম গল্পগাঁথা 'গিলগামেশের মহাকাব্য'-ও রচিত হয়েছে এই অমরত্ব ঘিরে। চার হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ায় রাজা গিলগামেশকে নিয়ে লেখা এই মহাকাব্যে উঠে এসেছে মৃত্যু-দর্শন। সবচেয়ে কাছের বন্ধুর মৃত্যুর পর নিজের অমরত্ব নিয়ে প্রশ্ন করে গিলগামেশ, "আমাকেও মরতে হবে?"
দুঃখ-যন্ত্রণায় মেসোপটেমিয়ার পিটার থিয়েল হয়ে উঠেন গিলগামেশ! মৃত্যুকে জয় করার সন্ধানে নামেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে খুঁজে পান জীবনের অর্থ।
"মানুষের জন্ম হয়, তারা বাঁচে আর তারপর ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে
সৃষ্টিকর্তাই এই আদেশ দিয়েছেন
কিন্তু শেষ দিন না আসা পর্যন্ত জীবন উপভোগ করো,
হতাশায় নয়, সুখী হয়ে বাঁচো
যে শিশুটি তোমার হাত ধরেছে তাকে ভালোবাসো
জীবনসঙ্গীকে আলিঙ্গন করে বুঝিয়ে দেও তার প্রতি ভালোবাসা
মানুষের বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠ উপায় এই।"
গিলগামেশ বলে গিয়েছিলেন বটে, তবে সেই বার্তা সবার কাছে পৌঁছায়নি। চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াংয়ের কথাই ধরুন। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীর এই সম্রাট যেকোনো মূল্যে অমরত্ব লাভ করতে চেয়েছিলেন।
গিলগামেশের মতো কিনও মৃত্যুকে ভয় পেতেন। স্টিফেন কেভের বই "ইমরটালিটি" অনুসারে, একবার কিন এক গ্র্যাফিটির কথা জানতে পারেন যেখানে তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছিল 'তোমাকেও মরতে হবে'। কিন সমস্ত সেনাদের আদেশ দেন এই কাজের পেছনে জড়িতদের খুঁজে বের করতে। কিন্তু দুষ্কৃতিকারীরা পালিয়ে গেলে তিনি ওই অঞ্চলের সবাইকে হত্যার নির্দেশ দেন। নিজের প্রচণ্ড মৃত্যুভীতি থাকা সত্ত্বেও প্রজাদের জবাই করা কিনের জন্য তেমন কোনো বিষয় ছিল না।
একদিন জু ফু নামের রহস্যময় এক ব্যক্তি এসে সম্রাটকে অমরত্ব দিতে পারবে বলে দাবি করেন। নিজেকে জাদুকর পরিচয় দেওয়া জু ফু জানান পূর্ব চীন সাগরের এক জাদুকরী দ্বীপে জীবনামৃত পাওয়া যেতে পারে। কিন জুকে বিশ্বাস করে তার সেই দ্বীপে যাওয়ার আয়োজন করতে মোটা অঙ্কের অর্থ দেন।
তবে সেরকম কোনো দ্বীপ অবশ্যই ছিল না। জু ধুরন্ধর মানুষ ছিলেন যিনি চার্লস পঞ্জির মতো ঠগ হয়েও ডেসমন্ড টুটুর মতো সন্তের বেশ নিয়ে চলতে জানতেন।
কিন্তু তারপরও সম্রাটের নেশা সহজে কাটেনি। দীর্ঘায়ু পেতে তিনি বিভিন্ন সব তরলের সংমিশ্রণে তৈরি এক ধরনের পানীয় খেতে শুধু করেন। শেষ পর্যন্ত মাত্র ৪৯ বছরেই মার্কারির বিষয়ক্রিয়ায় মারা যান কিন।
তবে কিন একমাত্র ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নন যিনি ভেবেছিলেন ককটেল পানেই অমরত্ব লাভ করা সম্ভব। ১৬ শতকের ফ্রান্সের সেরা সুন্দরী হিসেবে পরিচিত ছিলেন ডায়ান ডি পোয়েটার্স। নিজের সৌন্দর্য রক্ষায় রীতিমতো স্বর্ণ পান করতেন এই নারী।
তবে পোয়েটার্স শুধু শুধুই কিন্তু সোনা বেছে নেননি। মধ্যযুগে রসায়ন বিদ্যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পরশপাথরের সন্ধান লাভ। এই পরশপাথর এক ধরনের পাথর যা যেকোনো ধাতুকে সোনায় রূপান্তরিত করার পাশাপাশি অনন্ত জীবন দিতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করা হতো।
প্যারিসের ১৪ শতকের আলকেমিস্ট নিকোলাস ফ্লামেলের মৃত্যুর পর তো চাউরই হয় যে তিনি পরশপাথর আবিষ্কার করেছিলেন। ফ্লামেল আসলেই অমরত্ব পেয়ে ঘাপটি মেরে আছেন কি না, তা জানা না গেলেও তিনি যে 'হ্যারি পটার' লেখায় জে কে রাউলিংকে অনুপ্রাণিত করেছেন, সেজন্য তাকে ধন্যবাদ দেওয়াই যায়।
ইতিহাস জুড়ে বহুবার জনপ্রিয় অ্যান্টি-এজিং উপাদান হিসেবে রক্তের কথা পাওয়া যায়! ১৪৯২ সালে মুমূর্ষু পোপ অষ্টম ইনোসেন্টের দেহে ইঞ্জেকশনের সাহায্যে শিশুদের রক্ত প্রবেশ করানো হয়। ইতালীয় পণ্ডিত মারসিলিও ফিসিনোর ধারণা ছিল শিশুদের রক্ত গ্রহণে বয়সের কাঁটা পেছানো সম্ভব। তবে ফিসিনো রক্তের সঙ্গে চিনি ও গরম পানি মেশানোর পরামর্শও দেন। কিন্তু সেই ঘটনায় শুধু পোপ ইনোসেন্টই নন, তাকে রক্ত দেওয়া শিশুদেরও মৃত্যু হয়।
তবে এর থেকে বীভৎস ঘটনা আছে। কুমারী মেয়েদের রক্তস্নানের কথা কে শুনেছেন? ১৭ শতকের শুরুতে হাঙ্গেরিয়ান কাউন্টেস এলিজাবেথ বাথরির বিশ্বাস ছিল যে নিয়মিত রক্তে ডুব দিলে তার চামড়ায় ভাঁজ পড়বে না।
এর প্রায় দুই শতাব্দী পর বিশিষ্ট এক স্নায়ু বিশেষজ্ঞ দাবি করেন গিনিপিগ ও কুকুরের অণ্ডকোষের ইঞ্জেকশন নিলে তার নিজেকে ৩০ বছরের ছোট মনে হয়। আরেক সার্জন এই ধারণা এতটাই গুরুত্বের সঙ্গে নেন যে বার্ধক্য রোধে তিনি বয়স্ক পুরুষের দেহে বানরের অণ্ডকোষ স্থাপন করেন। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে "লাইফ: আ স্টাডি অব দ্য মিনস অব রিস্টোরিং ভাইটাল এনার্জি অ্যান্ড প্রলংগিং লাইফ" ঘেটে দেখতে পারেন!
২০ শতাব্দীতে এসেও অমরত্বের সন্ধান থামেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন তুঙ্গে তখন নাৎসি নেতা হাইনরিখ হিমলার হলি গ্রেইল খুঁজে পেতে অনুসন্ধান শুরু করেন। ধারণা করা হয় হলি গ্রেইল হলো লাস্ট সাপারের সময় যীশুখ্রিস্টের ব্যবহৃত পানপাত্র। মধ্যযুগ থেকে শোনা যায় যে গ্রেইল থেকে পানি পান করলে মৃত্যু এড়ানো সম্ভব। এসএস প্রধান হিমলারের বিশ্বাস ছিল এই হলি গ্রেইল তাকে অমরত্ব দেওয়ার পাশাপাশি অতিমানবীয় ক্ষমতা প্রদান করবে। তবে তার এই আশা পূরণ হয়নি। ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ার সময় তিনি সায়ানাইড পিল খেয়ে মারা যান।
যাই হোক তবু যদি আপনি চিরকাল বেঁচে থাকার আশা করেন, তাহলে মধ্যযুগীয় রূপকথাগুলো আপাতত বাদ দিন। এর পরিবর্তে সেল প্রোগ্রামিং সম্পর্কে পড়াশোনা করুন। সম্প্রতি লন্ডন ইন্সটিটিউট ফর ম্যাথমেটিকাল সায়েন্সেসের কনফারেন্সে সেল রিকোডের বিষয়টি আলোচিত হয়।
এলআইএমএসের পরিচালক টমাস ফিঙ্ক বলেন, "তাত্ত্বিকভাবে দীর্ঘায়ু পেতে জিন প্রকৌশলের ব্যবহার সম্ভব। এর জন্য প্রথমেই জানা দরকার আমরা কেন বুড়িয়ে যাই।" তিনি বলেন, "বার্ধক্য অনিবার্য এমনটাই মনে করা হয়। সময়ের সঙ্গে প্রতিটি জীবের অবক্ষয় ঘটে এবং মৃত্যু হয়। গল্প এখানেই শেষ।"
"কিন্তু গল্পটি আমরা যেমন ভাবি তার চেয়ে অনেক বেশি ভিন্ন। প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে দ্রুত বার্ধক্য আসতে পারে। এটা চমকপ্রদ। এর অর্থ এই যে কয়েক বিলিয়ন বছর আগে যে প্রাণ সঞ্চারণ হয়েছিল, সম্ভবত তাদের মৃত্যু হয়নি," বলেন তিনি।
"বিবর্তনের সময় মৃত্যুর আবির্ভাব ঘটে। কেননা সেটাই আসলে ভালো হয়েছিল। সহজ ভাষায় বললে, যে প্রজাতিগুলো মারা গিয়েছিল তারা অন্যান্য প্রজাতির চেয়ে অনেক এগিয়ে যায়।"
ফিঙ্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হলো, "অমরত্ব- মৃত্যুহীনতা- একটি প্রাকৃতিক অবস্থা"। এখন প্রশ্ন হলো আমরা কীভাবে সেই প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারি? এখানেই আসে সেল প্রোগ্রামিং।
বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এখন বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে আছে বিট.বায়ো যারা আলঝেইমারের মতো রোগ নিরাময়ের চেষ্টায় কোষগুলো পুনরায় কোড করার চেষ্টা করছে। দীর্ঘমেয়াদে বিজ্ঞানীরা এই বৈপ্লবিক জীবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অমরত্বের জন্য প্রযোজ্য কোষগুলো পুনরায় সেট করতে সক্ষম হবেন এমনটাই আশা করা যাচ্ছে।
বিট.বায়োর সঙ্গে কাজ করেন এলআইএমএসের জুনিয়র ফেলো ফরেস্ট শেলডন। তার ধারণা, "বার্ধক্য প্রক্রিয়াটি যদি কোষের ভেতরে ট্রান্সক্রিপশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া হয় তাহলে আমরা বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হব"।
তবে ফিঙ্ক ও শেলডন দুজনেই জানান অমর হওয়ার সুযোগ আসতে এখনও বহু দেরি। তাই খুব বেশি খুশি হওয়ার কিছু নেই। হাতের কাজ ফেলে না রেখে এখনই সেরে ফেলুন।
- সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট