ভোজ্যতেলের সংকট: মজুদের বিষয়ে সরকারি নীতি চাইলেন ব্যবসায়ীরা
ঈদের আগে ও পরে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট নিয়ে ব্যবসায়ীরা একে অপরকে দোষারোপ করেছেন। একই সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে যেসব মজুদকারীদেরকে ধরা হচ্ছে তাদেরও দোষ দেখছেন না দোকান মালিকদের সংগঠনের নেতারা। তারা আরও দাবি করেছেন মিলার, পাইকারি ব্যবসায়ী, ডিলার, দোকানিরা কে কতদিন, কী পরিমাণে তেল মজুদ রাখতে পারবে তার একটা নীতিমালা করে দেয়ার।
বুধবার ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) ভোজ্যতেলের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি বৈঠক করে। এ সময় খুচরা দোকানিদের প্রতিনিধি, পাইকারি ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা এসব কথা বলেন।
এই বৈঠকে মিল মালিকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলেও তা খুব বেশিদিন রাখতে পারবে না, তারা রপ্তানি উন্মুক্ত করবেই। তবে এই সময়ের মধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের একটা সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যে কারণে তেল কেনা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তেল পাওয়া গেলেও আবার জাহাজের স্পেস না পাওয়ায় শিপমেন্ট ডিলে হচ্ছে।
মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, 'এটা আমাদের সামনের দিনে সরবরাহ সংকট তৈরি করতে পারে। যে কারণে এই সংকটকালীন সময়ে সরকার যদি জিটুজির মাধ্যমে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া থেকে ৪-৫ লাখ টন তেল আমদানি করে আমাদেরকে দেয় তাহলে এই শঙ্কাটা থাকবে না।'
মৌলভিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, মিল মালিকরা দাম বাড়বে জেনেই সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছিল।
তিনি বলেন, 'রাজশাহীর যে ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হলো তার প্রতিদিনের চাহিদা কত সেটা আগে জানতে হবে। কারণ এক ট্রাকের মধ্যে ৬০ ড্রাম (প্রতি ড্রামে ২০৪ লিটার) করে তেল পরিবহন করা যায়। সে সপ্তাহে অন্তত ১০ ট্রাক তেল নেয়। তার কাছে ৬০-৭০ ড্রাম তেল থাকাটা দোষের কিছু নয়। এখানে যেভাবে তার সম্মানহানি করা হয়েছে তা ঠিক হয়নি।'
নিউমার্কেটের দোকান মালিকদের সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের দাবি করেন, 'ঈদের দুই-তিন দিন আগে থেকেই ডিস্ট্রিবিউটররা তেল দেয় নাই। যারা সামান্য তেল সরবরাহ করেছে তারাও বাধ্য করেছে চা, পোলাওয়ের চাল সহ বিভিন্ন পণ্য নিতে। এর মধ্যে সিটি গ্রুপ একটি।'
একইভাবে ভোক্তার অভিযানে খুচরা ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল হক ভুঁইয়া।
এ সময় এস আলম গ্রুপের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার কাজী সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আমরা দাম না বাড়ানোর কমিটমেন্ট করেছি। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এটাও জানিয়েছিলাম ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে যেভাবে অস্থিরতা শুরু হয়েছে তাতে বেশিদিন দাম সমন্বয় না করা ঠিক হবে না। পরে হয়তো একেবারেই ৬০-৭০ টাকা বাড়ানোর দরকার পড়তে পারে। মন্ত্রণালয় বিষয়টা ঠিকমতো পর্যবেক্ষণ করতে পারে নাই। সংকটের পেছনে এটা একটা বড় কারণ ছিল।'
পাইকারি ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক নেতাদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানতে চান- তেল যতই থাকুক, সংকটের সময়ে দোকানে না রেখে সেটা যদি গোডাউনে রাখা হয় তাহলে সেটা সঠিক কিনা। সংকটের সময় এটা ঘটেছে বলেই তাদেরকে ধরা হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'আজ সারাদেশের মাত্র ১ শতাংশ অসৎ ব্যবসায়ীদের কারণে সমস্ত ব্যবসায়ীদেরকেই বদনাম শুনতে হচ্ছে। যা আমরা চাই না। সরকারের পাশাপাশি আপনারাও সংগঠন থেকে অসৎ ব্যবসায়ীদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিন।'
তিনি বলেন, 'রোজার আগে মিলমালিকরা জানিয়েছিল তাদের কাছে যা মজুদ রয়েছে তা দিয়ে কোরবানির ঈদ পর্যন্ত চলবে, এই জায়গায় মিলারদের কমিটমেন্টে ঘাটতির কথা তুলে ধরেন। একই সঙ্গে যখন যে দাম তখন সেটা নিয়মিত আপডেট করা বিষয়েও মতামত দেন।'
এ প্রশ্নের পর দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল হক ভুঁইয়া বলেন, সত্যিকার অর্থেই যদি কেউ মজুদ করে থাকে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ভবিষ্যতে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এবং তেলের ব্যবসাটা যাতে সুষ্ঠুভাবে মনিটরিং করা যায় সেজন্য ব্যবসায়ীরা কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরেন। এর মধ্যে- সারা বছরের চাহিদার অন্তত ২০ ভাগ টিসিবির মাধ্যমে আমদানি করা, এই সংকটের সময়ে জিটুজি পদ্ধতিতে ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়া থেকে তেল আমদানি করে দেয়া, খুচরা, পাইকারি, ডিলাররা কতদিন ও কী পরিমাণে তেল মজুদ রাখতে পারবে তা নির্ধারণ করে দেয়া এবং সবার জন্য আমদানি উন্মুক্ত করার পরামর্শ দেন।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবনাগুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে উপস্থাপন করা হবে। এর পাশাপাশি ফিনিশড তেলগুলো যাতে শুল্ক তুলে দিয়ে আমদানির ব্যবস্থা করা হয় সে বিষয়েও প্রস্তাবনা দেওয়া হবে।
এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে তেলের বাজারে সংকটের বিষয়ে বলেন, ব্যবসায়ীরা রোজায় দাম বাড়াবে না, তাদের এই কথা বিশ্বাস করাটা ভুল ছিল।