পুরনো সরবরাহ আদেশের চাপে বিপাকে ভোজ্যতেল সরবরাহ
গত ৫ মে থেকে সরকার ভোজ্যতেলের খুচরা-পাইকারি পর্যায়ে নতুন দর নির্ধারণ করে দেয়। এ ঘোষণায় আগের চেয়ে সয়াবিনে লিটারপ্রতি দর ৩৮ টাকা বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়েছে দেশের খুচরা ও পাইকারি বাজারের ভোজ্যতেলের সরবরাহ ব্যবস্থায়। দাম বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘদিনের পুরনো এসও (সরবরাহ আদেশ) দিয়ে ভোজ্যতেল উত্তোলনের হিড়িক পড়েছে। কিন্তু পুরনো এসও নিয়ে ভোজ্যতেল সরবরাহ দিতে গড়িমসি করছে মিল মালিকরা। কোন কোন মিল মালিক ভোজ্যতেল সরবরাহ দিলেও প্রতি এসও-তে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়তি টাকা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি ভোজ্যতেল আমদানি ও পরিশোধনকারী কোম্পানির কারখানা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সরকার নির্ধারিত দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা আগের কেনা মেয়াদোত্তীর্ণ এসও নিয়ে মিলগেটে হাজির হচ্ছে্ন। সরকারিভাবে এসও ইস্যুর তারিখের পর ১৫ দিনের মধ্যে মিলগেট থেকে ভোজ্যতেল সংগ্রহ করে ফেলার নির্দেশনা দেয়া রয়েছে আমদানিকারকদের। এ কারণে দীর্ঘদিনের পুরনো এসও নিয়ে বিপাকে পড়েছে ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান, ডিও ব্যবসায়ী ও পাইকারি পর্যায়ে ডিও কিনে মজুদ রাখা ব্যবসায়ীরা।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে পাইকারিতে প্রতি মণ (৪০ দশমিক ৯০ লিটার) সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৭ হাজার ৫০০ টাকায় ও এসও পর্যায়ে ৭ হাজার টাকায়। পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে পাইকারিতে ৭ হাজার ও এসও পর্যায়ে ৬ হাজার ৫০০ টাকায়। পাম সুপার অয়েল পাইকারি পর্যায়ে ৭ হাজার ২০০ ও এসও পর্যায়ে ৬ হাজার ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যদিও বর্তমান সরকার নির্ধারিত দাম পাইকারি বাজারের দামের চেয়েও বেশি।
মঙ্গলবার আনোয়ারা উপজেলার কুলগাঁও-এ এস আলম গ্রুপের ভোজ্যতেল রিফাইনারি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় অর্ধশতাধিক ট্রাক ভোজ্যতেলের খালি ড্রাম নিয়ে মিলগেটে অপেক্ষা করছে। গেটে অপেক্ষারত ট্রাক ড্রাইভাররা জানিয়েছেন, ঈদের পর থেকে কয়েক দফায় ভোজ্যতেল সংগ্রহ করতে মিলগেটে আসলেও সরবরাহ না হওয়ায় ফেরত যেতে হচ্ছে ট্রাকগুলোকে। শনিবার থেকে সীমিত পরিসরে সরবরাহ কার্যক্রম শুরু হলেও পুরনো এসও নিয়ে আসা চালকদের ভোজ্যতেল সরবরাহ করতে গড়িমসি করছে মিল মালিকরা।
মিল এলাকায় ভোজ্যতেল নিতে আসা ট্রাকচালক মো. ফিরোজ বলেন, 'সয়াবিন ও পাম অয়েল সংগ্রহ করার জন্য এসও নিয়ে ঈদের পর থেকে প্রতিদিন মিলগেটে এসেও সংগ্রহ করতে পারিনি। মিলগেটে তেল সরবরাহ করতে না পেরে বসে থাকলে প্রতিদিনের জন্য ২ হাজার টাকা খরচ দেয় ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ২ হাজার টাকা পোষায় না। ভোজ্যতেল সংগ্রহ করতে এস আলম, সিটি গ্রুপের মিলে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে।'
অপর ট্রাকচালক উসমান গণি বলেন, যেসব চালক পুরনো এসও নিয়ে তেল সরবরাহ করতে এসেছে তাদের তেল দিতে গড়িমসি করছে মিলে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু কোন কোন মিলে ব্যবসায়ীদের (এসও ক্রেতা) ৫০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা দিয়ে পুরনো এসও দিয়ে তেল সরবরাহ করতে দেখা গেছে।
পুরনো এসও দিয়ে ভোজ্যতেল সংগ্রহের জন্য গত ৮ মে পর্যন্ত সময় বেধে দেয়া হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভোজ্যতেল সংগ্রহ করতে পারে নি ব্যবসায়ীরা।
একই দিন চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকার সিটি গ্রুপের ভিওটিটি অয়েল রিফাইনারিজ লিমিটেডের মিল এলাকায় দেখা যায়, ভোজ্যতেল সংগ্রহ করতে অন্তত ৩০টি ট্রাক মিলগেটে অপেক্ষা করলেও ভোজ্যতেল সরবরাহ করছে না মিল কর্তৃপক্ষ। মূলত পুরনো এসও নিয়ে মিলগেটে যাওয়ায় এসব এসও দিয়ে ভোজ্যতেল সংগ্রহ করতে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।
খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী এমদাদুল হক বলেন, ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সময় তেলের এসও বিক্রি করে বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা তুলে নেয়। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে খাতুনগঞ্জের এসও কিংবা ডিও ব্যবসা চলে আসছে। কিন্তু এবারে এসও মূল্যের চেয়ে তেলের দাম অতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে পুরনো এসও দিয়ে ভোজ্যতেল দিতে গড়িমসি করছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মিলে থাকা কর্মকর্তারা। বিভিন্ন কোম্পানির মিল বাড়তি টাকা আদায় করে তেল সরবরাহ দিচ্ছে। বাড়তি এই টাকা কোম্পানিভেদে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ এমদাদুল হকসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীদের।
ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের ডিজিএম (সেলস) প্রদীপ কারণ বলেন, 'দীর্ঘদিনের পুরনো এসও নিয়ে তেল সরবরাহ না দিতে ভোক্তা অধিকারের নির্দেশ রয়েছে। পুরনো এসও হাতে থাকা ব্যবসায়ীদের গত ৮ মে'র মধ্যে তেল সরবরাহ নিতে কোম্পানিগুলো সময় বেধে দিয়েছিল। কিন্তু এরপরও বহু ব্যবসায়ী সময়মতো তেল সরবরাহ না নিয়ে এখন মিলে ভিড় করছে। এরপরও কোনো এসও ক্রেতার কাছ থেকে বাড়তি টাকা না নিয়েই আমরা তেল সরবরাহ করছি।'
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগীর আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিনের পুরনো এসও কারও কাছে থাকলে মিল মালিকদের সাথে আলোচনা করে সেগুলো সংগ্রহ করবে। সরকার দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পরও পাইকারি বাজারে ভোজ্যতেলের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। সরকারের কঠোর মনিটরিং থাকায় আমদানিকারক কিংবা ট্রেডিং ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভোজ্যতেলের সরবরাহ, বিপণন ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম হওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।